বরফ, ভাজা বিক্রেতা জব্বার ও গরুর দালাল বিল্লাল হঠাৎ বনে যায় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

যশোরের মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় পুলিশের কাছে আটক আব্দুল জব্বার বরফ বিক্রেতা ও নারী পাচারকারী এবং বিল্লাল হোসেন গরুর দালাল হিসেবে পরিচিত। হঠাৎ সাংবাদিক হয়ে দাপিয়ে বেড়ানো জব্বার-বিল্লাল এলাকার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

সরেজমিনে, বাঁকড়া গ্রামের গিয়ে গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বরফ, ভাজা বিক্রেতা ও নারী পাচারকারী আব্দুল জব্বার এবং গরুর দালাল বিল্লাল হোসেন রাতারাতি মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক হয়ে যায়। আব্দুল জব্বারের লেখাপড়ার যোগ্যতা টু পাস ও বিল্লাল হোসেন এসএসসি পাস। আব্দুল জব্বার লেখেন জাতীয় পত্রিকা, ১০ টি অনলাইন এবং ৩ টি ইউটিউব চ্যানেলে। বিল্লাল হোসেন মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক। দুজনে মোটরসাইকেলের সামনে প্রেস লিখে ঘুরে বেড়ান বাঁকড়া এলাকা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে। যেখানে মহিলাদের ঝগড়া-ঝাটি, সেখানেই চলে যান মূহুর্তের মধ্যে এবং মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও করা আর মহিলাদের উপর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। ইতিমধ্যে লাঞ্চিতও হয়েছে কয়েকবার। সব মিলিয়ে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বলে এলাবাসীর অভিযোগ।

আরো পড়ুন :
গাইবান্ধায় করোনা সংক্রমন রোধে শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ৩ ব্যবসায়িকে জরিমানা
আলমডাঙ্গায় সাপের কামড়ে স্কুল ছাত্রের মৃত্যু

এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গেলে আব্দুল জব্বার সম্পর্কে বিভিন্ন অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া গ্রামের আবুল কাশেম ওরফে দুখীর ছেলে আব্দুল জব্বার। ৬ ভাইবোনের মধ্যে জব্বার সবার বড়। তার পিতা অভাবের তাড়নায় নিজ বসতভিটা ছেড়ে চলে যান মণিরামপুর উপজেলার পাঁচপোতা গ্রামে। সেখানে দীর্ঘদিন বসবাস করেছে। ছোট বেলায় আব্দুল জব্বার তার পিতার সাথে বরফ ও ভাজামুড়ি বিক্রয় করত। পরে তার মায়ের সাথে চোরায় পথে ভারতে পাড়ি জমায়। মুম্বাই শহরে দীর্ঘদিন থাকে। এরই মধ্যে সখ্যতা গড়ে তোলে একই গ্রামের রেজাউল ইসলামের মেয়ের সাথে এবং তাকেই বিয়ে করে। তার বউ এখনও মুম্বাই শহরে থাকে। আব্দুল জব্বার বাংলাদেশ থেকে এলাকার মেয়েদের কাজ দেয়ার নাম করে মুম্বাই শহরে নিয়ে যায়। সেখানে তার স্ত্রী তাদের রিসিভ করে। পরে তাদের বিভিন্ন বারে বিক্রয় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাঁকড়া গ্রামের শহিদুল ইসলামের মেয়েকে ভারতে কাজ দেয়ার কথা বলে নিয়ে যেয়ে বিক্রয় করে দিয়েছিল। পরে অবৈধ অভিবাসী হিসাবে ভারতের পুলিশের কাছে আটক হলে ১৪ মাস জেলে থাকে। পরে ভারত সরকার তাকে বাংলাদেশ ফেরত পাঠায়। সে বাড়ি ফিরে মেয়ে আব্দুল জব্বারের নামে নারী পাচারের মামলা করেন। দীর্ঘ ৬ বছর মামলাটি চলেছে।

আব্দুল জব্বার নিজের অপরাধ ঢেকার জন্য স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয় এবং বাঁকড়া ইউপি চেয়ারম্যানের সান্নিধ্য লাভ করেন। এ সুযোগে আব্দুল জব্বার এলাকার সন্ত্রাসীদের নিয়ে নারী পাচার মামলার বাদীকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। অবশেষে চাপে পড়ে বাদি তার মামলা তুলে নেয়। এবং জব্বারের কাছে থাকা একটি সোনার কানের দুল ও নগদ কিছু টাকা ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও তা ফেরত দেয়নি।

এলাকা থেকে অনেকে মেয়ে আব্দুল জব্বার ভারতে পাচার করে বিক্রয় করেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ মামলার বাদি জানান। তার মা দীর্ঘদিন মুম্বাই শহরে থেকেছে। তার স্ত্রী এখনও মুম্বাই শহরে থাকে এবং বারে কাজ করে।

বরফ ও ভাজামুড়ি বিক্রয়, নারী পাচার সবশেষে স্থানীয় একজন প্রতিনিধির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শেষ করে সম্প্রতি সাংবাদিক হয়েছে আব্দুল জব্বার। তার নামে ৪টি ফেসবুক আইডি আছে। ভারতে গেলে একটি আইডি চলে, বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় সাবেক এমপির নিয়ে একটি আইডি এবং বর্তমান এমপি ও অন্যন্য নেতাদের নিয়ে একটি আইডি চলে। যখন যে নেতারা ক্ষমতায় আসে তাদের নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন লেখা দিয়ে তাদের ছত্রছায়ায় যাওয়ার চেষ্টা করে। তার ফেসবুক আইডি খুজে দেখা গেছে, সে জাতীয় মাতৃজগত নামে একটি পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে লেখে। যার অতিত্ব এলাকার মানুষ কোনদিন দেখেনি। মাতৃজগত টিভির জেলা প্রতিনিধি, জেটিভির জেলা প্রতিনিধি, ক্রাইম টিভির জেলা প্রতিনিধি। এছাড়া অনলাইন আলোচিত বার্তার যশোর জেলা ব্যুরো প্রধান, ক্রাইম২৪ তালাশ ডটকমের ঝিকরগাছা প্রতিনিধি, জাতীয় মাতৃজগতের স্টাফ রিপোর্টার, জনকন্ঠ নিউজের ঝিকরগাছা প্রতিনিধি, অন্যদৃষ্টির ঝিকরগাছা প্রতিনিধি, দৈনিক কপোতাক্ষ নিউজের যশোর জেলা ব্যুরো প্রতিনিধি, দৈনিক অপরাধ অনুসন্ধানের জেলা প্রতিনিধি, বিজয় বাংলা নিউজের যশোর জেলা ব্যুরো প্রধান ও ক্রাইম নিউজের যশোর জেলা প্রতিনিধি হিসাবে তিনি সাংবাদিকতা করেন।

এখন স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্ন, একজন ব্যক্তি বাঁকড়ার মত মফস্বল জায়গায় থেকে জেলা প্রতিনিধি হিসাবে কিভাবে সাংবাদিকতা করতে পারেন? বাঁকড়ায় বসে যশোর, শার্শা, বেনাপোল, চৌগাছা, মণিরামপুর, বাঘারপাড়া, উভয়নগর, কেশবপুরসহ প্রত্যেক জায়গায় নিউজ তারা কিভাবে সংগ্রহ করেন? এ ব্যাপারে তথ্য অনুষ্ঠান করে দেখা গেছে, তারা বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা ও ফেসবুক থেকে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহ করে তারা কপি করে এবং সেগুলো ঐসব নাম সর্বস্ব অনলাইন পত্রিকায় দিয়ে নিজের ফেসবুকে ছাড়ে।

আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে তার গ্রামের সাধারন মানুষও অতিষ্ঠ হয়ে আছে এবং তাদের একটি প্রশ্ন, সাংবাদিক হতে গেলে কি কোন যোগ্যতা লাগে না? টু ক্লাস পাস করে কি সাংবাদিক হওয়া যায়? এ ব্যাপরে কথা হয় বাঁকড়া গ্রামের ফজর আলী নামে এক ব্যক্তির সাথে। তিনি বলেন, তার জীবনের সবকুল শেষ হয়েছে। এখন সাংবাদিক হয়েছে। কোন যোগ্যতায় সে সাংবাদিক হয়েছে, সেটা আমাদের জানান নেই। তার নামে নারী পাচার মামলা ছিল। জোর পূর্বক তুলে নিয়েছে। আমি সেই মামলার দুই নম্বর সাক্ষী ছিলাম।

বাঁকড়া গোন্দুর মোড়ের মুদি দোকান্দার তোহিদ বলেন, যে লিখতে পারে না, যে স্কুলের বারান্দায় যায়নি, সে সাংবাদিক হয় কিভাবে? এর আগে চেয়ারম্যানের চামচামি করত। এখন কিছুই করে না। তাহলে ওর চলে কিভাবে? এলাকার কোন বাড়িতে যদি বউ-শ্বাশুড়ি ঝগড়া করে, সেখানে তারা চলে যায় ভিডিও করতে।

বাঁকড়া গ্রামের আব্দুল লতিফ জানান, সেদিন আমার সাথে জব্বারের দেখা হয়েছিল, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুইতো সাংবাদিক, তোরতো কোনদিন টিভিতে দেখলাম না? তখন জব্বার উত্তর দিল- ফেসবুকে দেখতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, জব্বার অতিরিক্ত করে ফেলছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা নেয়। কয়েকদিন আগে একটি পার্ক থেকে ১৭ হাজার টাকা এনেছে। ফেসবুকে লেখার কারণে বাজারের রেজাউল ইসলাম নামে এক দোকান্দারের নিকট থেকে টাকা নিয়েছে। আর্সেনিকমুক্ত টিউবয়েল দেয়ার নাম করে ইউনিয়নের বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে টাকা নিয়েছে।
মজনু নামের এক ব্যক্তি বলেন, ও বোম্বে থাকতো। ওর বউ বাচ্চা এখনও বোম্বে আছে। সর্বশেষ শিমুলিয়া গ্রাম থেকে একটি মেয়েকে ভারতে পাচার করেছে বলে আমরা শুনেছি।

আব্দুল জব্বারের শ্বশুর রেজাউল ইসলাম জানান, আমার মেয়েকে বিয়ে করার পর তাদের সাথে আমি সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।

এদিকে বিল্লাল হোসেন এলাকায় গরুর দালালি করে সংসার চালাতো। হঠ্যাৎ করে সে মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক বনে যান। কিছুদিন আগে একটি অসুস্থ গরু কেনার পর সে গরু মারা যায়। বিল্লাল সে গরু জবাই করে দিয়ে তার মাংস গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রয় করেছিল। লোক জানাজানি হলে গ্রামবাসী সে মাংস ফেরত দেয় এবং কেউ সে মাংসের টাকা দেয়নি। বিল্লাল তার বৃদ্ধ মাকেও দেখে না বলে গ্রামের মানুষ জানিয়েছে।

রবিবার সকালে আব্দুল জব্বার ও বিল্লাল হোসেনসহ চার প্রতারক যশোরের কোতয়ালি থানার কাশিমপুর গ্রামে এক বিবাহ রেজিষ্ট্রারের কাছে চাঁদা দাবীর করলে স্থানীয়রা তাদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। চাঁদাবাজির মামলায় পুলিশ তাদের জেল-হাজতে প্রেরণ করেছে। এ খবর বাঁকড়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে।

মে ১৮, ২০২০ at ১৭:৪৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এমএ/এএডি