আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা

হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে ‘ফায়ার’ বললে যেমন আগুনের আতঙ্ক না ছড়িয়ে বরং অপেক্ষা সৃষ্টি হয় এক্ষুনি গুলির শব্দ আসবে বলে। তেমনি লকডাউন ঘোষণা না করে লকডাউন সৃষ্টি করাটাও বিভ্রান্তিকর, বাস্তবায়নও কঠিন।

সারাদেশের মতো কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে অবৈধ ট্রলি সবসময়ই অবৈধ, ট্রলি বা স্টিয়ারিং এসব নামে পরিচিত গাড়িগুলোর চালক মূলত দিনমজুর তরুণ। প্রসঙ্গ এটা নয়। করোনা নিয়ে তোলপাড় হওয়ার পরপরই গ্রামের মানুষ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টায় সতর্ক হয়ে যাবেন এমন মানুষও আমরা নই। প্রসঙ্গ সেটাও নয়। দেশের সামগ্রিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠায়, সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিকতা প্রতিষ্ঠায় আতঙ্ক নয়, আমরা চাই সচেতনতা ও পর্যাপ্ত পরামর্শ।

আমাদের জানতে দেরি হয়। আমাদের বুঝতে দেরি হয়। আমাদের মানতে দেরি হয়। এটা তো অবশ্যই সবার কাছে পরীক্ষিত। যে অবৈধ গাড়ির কথা বলছিলাম, মাস্ক পরে ইট বোঝাই় সেই ট্রলি চালিয়ে আসা দিনমজুর তরুণ ড্রাইভারকে রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় যে পুলিশ কানে ধরে উঠ-বস করাচ্ছিলেন তার নিজের টিমে থাকা অপরিচিত লাঠিয়াল (প্রশাসনের নয়) মাস্ক, গ্লাভস কোনটাই পরেননি। অথচ নিজেই চেক করছেন পাবলিকের মোটরসাইকেলের কাগজপত্র।

প্রশাসনের চোখে অপরাধী সেই ট্রলি ড্রাইভার গ্লাভস না চিনলেও কুষ্টিয়ার মফস্বল উপজেলা দৌলতপুরে প্রচারণা শুরুর ৪৮ ঘণ্টায় মাস্ক চিনেছিলেন। এখানেই সচেতনতার গল্পটা শেষ নয়।

ফেসবুক লাইভে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে লাঠির বাড়ি খাওয়া, কান ধরে ওঠবস করা, গালাগাল খাওয়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনদের ভিডিও চিত্র। যাদের অধিকাংশের কাছেই পর্যাপ্ত তথ্য ও সতর্কতা পদ্ধতি-সরঞ্জাম না থাকায় আকস্মিক এমন অভিজ্ঞতায় কেবল হতবাক হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষের যে মাস্ক, গ্লাভসের সাথে পরিচয়টাও বেশ কম। তারও বেশি হতবাক হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে যখন দেখা যায়, দৌলতপুর উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত টিমে সদস্যদের ন্যূনতম সেফটি মাস্ক-গ্ল্যাভস নেই! খোদ ইউএনও ব্যবহার করেননি এসব সেফটি। বরং সতর্কতা ছড়ানোর চেয়ে, সতর্কতা পদ্ধতি-পরামর্শ পৌঁছে দেয়ার দলবলকে বেখেয়ালি আতঙ্ক ছড়াতেই দেখা গেছে বেশি।

করোনা প্রতিরোধে মাঠে যথেষ্ট পরিশ্রম করে চলেছে দৌলতপুর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ। কিন্তু এখনও অসচেতন আমরা, কেবল পিচঢালা রাস্তায় চলা বন্ধ করেছি। পাড়া-মহল্লা-পরিবারে আগের মতোই কমিউনিকেশন। যেসব দোকানপাট খোলার অনুমতি আছে তাদেরও অনেকে সতর্কতাগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে এখনও স্পষ্ট না। কাঁচাবাজার চালু রাখতে হলেও সেখানে প্রশাসন কোন চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ নেয়নি।

সেনাবাহিনী মাঠে নামার আগে করোনা প্রতিরোধে দৌলতপুর প্রশাসন ও পাবলিক সমন্বয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করা হলেও তার সমন্বিত কোন কার্যক্রম এখনও শুরু হতে দেখা যায়নি। উপজেলাটির দু’একটি সামাজিক সংগঠন ও কিছু মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবা পরিচালিত হলেও তাদের কোন উল্লেখযোগ্য গাইড নেই।

করোনা সংক্রমণ কতটা জোরদার তার সাথে প্রস্তুতি বা কার্যক্রমের জোরের কোন মিল থাকা দরকার আছে বলে মনে হয় না। সারাবিশ্বে করোনা পরিস্থিতি এবং আমাদের রাষ্ট্রের বারবার সতর্কতা কার্যক্রম আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় এসেছে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা। রাষ্ট্রের নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সেদিকেও নজর রাখতে হবে আমাদের তৃণমূলকে। সর্বোপরি বাংলাদেশে করোনা প্রাদুর্ভাব শনির শঙ্কা কম দিলেও আমাদের শতভাগ সতর্ক থাকতে হবে আরও বেশ ক’টা দিন। যদিও এখন পর্যন্ত স্থানীয়দের উদ্যোগে বিচ্ছিন্ন কিছু কার্যক্রম ছাড়া আস্থা রাখার মতো কোন প্রস্তুতি বা সমন্বিত কার্যক্রম আসেনি দৌলতপুরে।

তবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর গ্রামাঞ্চলের মানুষের ব্যাপকভাবে সতর্কতা বাড়তে শুরু করেছে। গবেষকরা বলছেন, ব্যক্তি সচেতনতাই প্রধান কার্যকর।

দৌলতপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের কার্যক্রম আর তার সাথে গণমাধ্যমকর্মীদের বিচ্ছিন্ন, অনিরাপদ ও অপেশাদার প্রচার বিভ্রান্তিতে ফেলেছে সাধারণ মানুষদের। দেখা গেছে, করোনা কার্যক্রমে দৌলতপুর প্রশাসনের টিমে থাকা সংবাদকর্মীরা জেলা প্রশাসনের ঘোষণা করা নিয়মের বাইরেই ভুল তথ্য প্রদান করে যাচ্ছেন।

আসলেও বিষয়গুলো অনেকটা এমন যে, নতুন ইস্যুতে পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে প্রশাসন-সংবাদকর্মী সবারই বুঝে উঠতে সময় লাগে। হয়তো বুঝে উঠতে সময় লাগছে সরল মানুষগুলোরও।

দৌলতপুর উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব ফেসবুক ওয়াল, বিভিন্ন অনলাইন প্রচারণা, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, স্থানীয় টিভি ক্যাবল নেটওয়ার্ক এসবের পর্যাপ্ত ব্যবহার করোনা ইস্যুতে বেশ কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও পিছিয়ে রয়েছে দৌলতপুর। এখন পর্যন্ত স্তর ভিত্তিক কোন কার্যক্রমের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কুষ্টিয়ার সবচে’ বড় এই উপজেলাবাসীকে স্বেচ্ছাসেবার জন্য এগিয়ে আসতে কিংবা বিত্তশালীদের সংগঠিত হতে এখনও কোন জোরালো আওয়াজ আসেনি কোন পক্ষ থেকেই। হয়তো আহ্বানের অপেক্ষায় আছেন অনেক হৃদয়বান ব্যাক্তিরা। সরকারের পক্ষ থেকে আসা ত্রাণ পর্যাপ্ত নয় সেই হিসাবও স্পষ্ট।

তবে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ঝড়-বন্যার মতো করোনা প্রকোপেও মানুষকে সহায়তা করতে গিয়ে সহায়ক মানুষেরা গুলিয়ে ফেলছেন সচেতনতার নিয়ম কানুন। আমার এই লেখাটি লেখার দিনে দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য এবং প্রতিটা উপজেলা পর্যায়ে সেনাবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়েছে এটাই আশার কথা। স্থবির গ্রামাঞ্চল ক্ষুধা বাড়াবে, হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে অর্থনীতি। তাই হয়তো বদলে নেয়া যেতে পারে করোনা প্রতিরোধ কৌশল।

সর্বোপরি, চলুন আমারা বাড়িতে একে-অপরের সাথে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে সহাবস্থান করি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বের হই। হলেও হাতমোজা-মাস্ক ব্যাবহার করি। একে অপরের সাথে ৬ ফুট দুরত্ব রেখে চলি। দিনে যত বেশি সম্ভব সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুই। নিরাপদ থাকি। সকলের সুরক্ষা প্রার্থনা করছি স্রষ্টার কাছে। নয় সমালোচনা; নয় অনাকাঙ্খিত ঘটনা।

লেখক : তাশরিক সঞ্চয়
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক