কেডিএস গ্রুপ চেয়ারম্যানের জামাতা ঋণের দায়ে লাপাত্তা

চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কেডিএস গ্রুপ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের জামাতা কেডিএস গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সরকার মোহাম্মদ শামীম ইকবাল এখন ঋণের দায়ে লাপাত্তা।

তিনি একসময় শ্বশুরের ব্যবসা দেখতেন, পরে বণিবনা না হওয়ায় নিজেই আলাদাভাবে ব্যবসা শুরু করেন। অভিজ্ঞতা ছিল বলেই শুরুতে পোশাক খাতে ব্যবসা দিয়ে আরম্ভ করলেন ব্যবসায়িক যাত্রা। ব্যবসায়ী মহল ও ব্যাংক জগতে তিনি এসএম শামীম ইকবাল নামে পরিচিত। ব্যবসায়ী শ্বশুরের পরিচয়ে সহজে মিলেছে ব্যাংকঋণ। তিনি বিনিয়োগ করেন জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়। রাতারাতি নামধারণ করে ‘লিজেন্ড গ্রুপ’। ২০১৪ সালে তিনি হয়েছিলেন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কেডিএস এক্সেসরিজের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়িক অদক্ষতা, ব্যর্থতা ও অনভিজ্ঞতায় বেড়েছে লোকসান ও ব্যাংকঋণ। এখন পর্যন্ত চার ব্যাংকে খেলাপি হয়েছেন ৩৯০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে চলতি মাসে নাম আসে পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি তালিকায়। অন্যান্য ব্যাংকের মতো পদ্মা ব্যাংকের পাওনা ২৭ কোটি টাকা পরিশোধ না করে লাপাত্তা হয়ে যান। পাওনা আদায়ে গত দুই বছর ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।

একাধিক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকার বাসিন্দা। বর্তমানে খুলশী এলাকার ৩নং রোডে ৩১/বি ৪, প্লট নং ৩১/বি ২ বনান্ড ভবনের বাসিন্দা এসএম শামীম ইকবাল লিজেন্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসার প্রয়োজনে পদ্মা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ২৭ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা নিয়েছিল। এ ঋণের বিপরীতে সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল ভাটিয়ারীতে ৭০৮ শতাংশ ও বাঁশবাড়িয়া মৌজায় ৬৬ শতাংশ এবং কক্সবাজারের ইনানিতে ১২২ শতাংশ জমি বন্ধকিতে আছে। অর্থাৎ, তিন জায়গায় মোট ৮৯৭ শতাংশ জমি বন্ধকিতে আছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পাওনা আদায়ে বন্ধকী জমি নিলামে বিক্রির চেষ্টা করছে। যদিও আগে একবার জমিগুলো নিলামে বিক্রির চেষ্টা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোচিং বাণিজ্য, সাংবাদিক দেখে পালিয়ে গেলেন শিক্ষক!

অপরদিকে ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখা এসএম শামীম ইকবালের মালিকানাধীন ডমিনিক্স রিয়্যালিটি (বিডি) লিঃ এর কাছে তাদের সুদাসলে এক কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ পাওনা আদায়ে মামলা চলমান আছে। এর মধ্যে মূল ঋণ ৪৬ লাখ টাকা। এবং ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার মোট পাওনা প্রায় ১৭৮ কোটি টাকা। শুধু ন্যাশনাল ব্যাংক নয়, সাউথইস্ট ব্যাংকের ১৪৬ কোটি টাকা, এবি ব্যাংকের ৬৫ কোটি টাকা ও ইস্টার্ন ব্যাংকের দেড় কোটি টাকা পাওনা আছে এ গ্রুপের কাছে। এখন পর্যন্ত চার ব্যাংকের খেলাপি পাওনার পরিমাণ ৩৯০ কোটি টাকা।

জানা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কেডিএস এক্সেসরিজ লিঃ ৩০ জুন ২০১৮ সালের এসএম শামীম ইকবালের ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ৩৩ হাজার ৯২৫। ৩০ জুন ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার ৬৮৮। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে শেয়ার বিক্রি করেছেন ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ২৩৭টি। একইভাবে তার স্ত্রী হাসিনা ইকবালও শেয়ার বিক্রি করেছেন ২১ লাখ ২১ হাজার ৬২২টি। ৩০ জুন ২০১৮ সালে তার ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ ছিল ২৭ লাখ ৭২ হাজার ১৪৪। ৩০ জুন ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে ছয় লাখ ৫০ হাজার ৫২২টি। আর এ দুজনই আছেন কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার হিসেবে।

একই সময় তিনি ডমিনিক্স এমআই লিমিটেড, ডমিনিক্স রিয়্যালিটি (বিডি) লিঃ, ভরটেক্স মাল্টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, স্কাই সিকিউরিটিজ ও গউস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। এছাড়া কেডিএস টেক্সটাইল মিলস লিঃ এর পরিচালক ছিলেন। তিনি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ও কেডিএস গ্রুপের নানা প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবিকে ব্যবহার করে নিজের নামে এসএম ট্রেডিং করপোরেশন, ডমিনিক্স এমআই লিঃ, হংকংভিত্তিক ডমিনিক্স গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট লিঃ, স্পার্ক ট্রেডিং কোম্পানি, রূপকথা কনস্ট্রাকশন লিঃ নামের একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মধ্যে হংকংভিত্তিক ডমিনিক্স গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট লিঃ এর চেয়ারম্যান ও হংকংভিত্তিক আরেক প্রতিষ্ঠান স্পার্ক ট্রেডিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যদিও তার অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব ও ব্যবসায়িক অনভিজ্ঞতায় ডুবে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তার ঋণ গ্রহণের কারণে বিপাকে পড়েছে ব্যাংক এশিয়া, ওয়ান ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইউসিবিএল, পদ্মা ব্যাংক লিঃসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ঋণের টাকা ফেরত পেতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চেক প্রত্যাখ্যান ও অর্থঋণ আদালতে মামলা করে।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের ঝামেলায় ফেলা হয়েছে। খেলাপি পাওনা আদায়ে একাধিকবার চেষ্টা করলেও ওই ব্যবসায়ী এক টাকাও ফেরত দেননি। ফলে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি।
আরও পড়ুন: প্রতিপক্ষের হামলায় গ্রাম ছাড়া ৩০ পরিবার

পদ্মা ব্যাংক লিঃ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাতুনগঞ্জ শাখাপ্রধান খোরশেদ আলম বলেন, এসএম শামীম ইকবালের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান এনএম ট্রেডিং করপোরেশন আমাদের খেলাপি গ্রাহক। প্রচলিত আইন, নিয়ম-নীতির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এর মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশে খেলাপি গ্রাহকের বন্ধকিতে থাকা জমি নিলামে বিক্রির ২য় বারের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, আগামী ৩ মার্চ খাতুনগঞ্জ শাখায় এ নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। এ নিলাম প্রক্রিয়ায় কেউ আগ্রহী থাকলে অংশগ্রহণ করতে পারেন। অন্যথায় অর্থঋণ আদালতে মামলা করব। যদিও তার বিরুদ্ধে চেক প্রত্যাখ্যানের দায়ে এনআই অ্যাক্টে মামলা চলমান আছে। খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুসারে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি।

সাউথ ইস্ট ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ গোলাম আজম ফারুক বলেন, এসএম শামীম ইকবাল প্রথম দিকে কেডিএস গ্রুপের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। পরে নিজে পোশাক ব্যবসা শুরু করলেও বেশি লাভের আশায় জাহাজ ভাঙা ব্যবসায় আসেন। সে ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বরে সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় (প্রিন্সিপাল শাখা) থেকে জাহাজ আমদানির জন্য ৪৩ কোটি টাকার ঋণপত্র ও ৩৯ কোটি টাকা টার্ম ঋণসহ সর্বমোট ৮২ কোটি টাকার ঋণ নেন তা গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সুদে-আসলে ১৪৬ কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৯ টাকায় দাঁড়ায়। এছাড়াও শিপ ব্রেকিং ব্যবসায় ব্যর্থতা এবং অর্থের অপব্যবহারের দায়ে ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। এরপর তিনি আস্তে আস্তে আড়ালে চলে যান। প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ উদাসীন ভূমিকা পালন করেছিল, যদিও ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক খেলাপি পাওনা আদায়ে ২০১৭ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। বর্তমানে মামলা চলমান আছে। সাউথইস্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের পক্ষে আমি বাদী হয়ে সীতাকুন্ড থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লিজেন্ড গ্রুপের মালিকানাধীন লিজেন্ড টেক্সটাইল, এসএম মাসিনারা এশিয়া লিঃ, লিজেন্ড পাওয়ার প্লান্ট, লিজেন্ড ট্যাঙ্ক টার্মিনাল, ইমাজিন হোটেল লিঃ, মৃতিকা এগ্রো ফার্মস, লিজেন্ড ট্রেড সেন্টার তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। এর মধ্যে কর্ণফুলী ইপিজেডে লিজেন্ড টেক্সটাইল, এসএম মাসিনারা এশিয়া লিঃ এবং এস্টেথেটিকস ইলেক্ট্রনিক্সস লিঃ নামের তিনটি কারখানা বহু আগেই বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া লিজেন্ড পাওয়ার প্লান্ট, লিজেন্ড ট্যাঙ্ক টার্মিনাল, মৃতিকা এগ্রো ফার্মস, লিজেন্ড ট্রেড সেন্টার নামে প্রতিষ্ঠান গুলো কেবল কাগজে-কলমে আছে। এছাড়া ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে ২ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় বন্ধ রেখেছে লিজেন্ড গ্রুপ। গ্রুপটির অফিস আগ্রাবাদের আস-সালাম টাওয়ারে ছিল। অনেকটা গোপনে প্রধান কার্যালয় অগোচরে সরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি শামীম ইকবাল আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স লিঃ এর একজন পরিচালক ছিলেন।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ৪০০

অপরদিকে দেড় বছর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন ব্যাংকে লিজেন্ড হোল্ডিংসের খেলাপি ৩৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। প্রকাশিত ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষ ২৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১ নম্বর তালিকায় স্থান পায় লিজেন্ড হোল্ডিং। আর ৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি জাহাজ কাটার জন্য কোনো জাহাজ আমদানি করেনি।

কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত ৩ প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে কর্ণফুলী ইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মসিউদ্দিন বিন মেজবাহ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান ৩টি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। আমরা টার্মিনেট করে দিয়েছিলাম। মালিক পক্ষ টার্মিনেশন তুলে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে এবং সে অনুযায়ী টার্মিনেশন তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অপারেশনে এখনও যায়নি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। তাদের বিজনেজ প্ল্যান কী, কী করবে না করবে, সেটা মালিক পক্ষ জানে।’

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএস শামীম ইকবালের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার এসআই (তদন্ত) হারুন উর রশিদ বলেন, অর্থ আত্মসাতের দায়ে ব্যবসায়ী এসএম শামীম ইকবালের বিরুদ্ধে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের পক্ষে একটি মামলা করা দায়ের হয়। মামলার দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করছি খুব দ্রুত তিনি গ্রেপ্তার হবেন।

দেশদর্পণ/এমএম/এসজে