আজ কাজী আরেফসহ পাঁচ জাসদ নেতা হত্যাকাণ্ডের ২১তম বার্ষিকী

আজ সেই বেদনাবিধুর ১৬ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা হত্যাকাণ্ডের ২১তম বার্ষিকী। প্রতি বছর আজকের এই দিনটি সামনে এলেই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় জাসদ নেতাদের মাঝে ভিন্ন রকম এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নিহত জাসদ নেতৃবৃন্দের স্মরণে শোকসভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

যেভাবে খুন হন পাঁচ জাসদ নেতা : ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে উপজেলা জাসদ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ চলছিল। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাতীয় নেতা কাজী আরেফ আহমেদ প্রধান অতিথির বক্তব্য শুরু করার পরপরই আততায়ীরা সমাবেশ মঞ্চের পূর্ব দিক থেকে ব্রাশফায়ার শুরু করেন। ৯-১০ জন আততায়ীর সবার হাতেই ভারি অস্ত্র ছিল। কুষ্টিয়া জেলা জাসদের তৎকালীন সভাপতি লোকমান হোসেনকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলি চালানো হয়। খুব কাছ থেকে গুলি করায় তার মাথার খুলি উড়ে যায়। ঘটনাস্থলে নিহত হন তিনি। এরপর জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী বুকের ঠিক মাঝখানে গুলিবিদ্ধ হন। তিনিও সমাবেশ মঞ্চে মারা যান। আততায়ীদের এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারে স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন বুকেসহ শরীরের আরো কয়েকটি স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন এবং শমসের মণ্ডল কপালে গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান।

ব্রাশফায়ারের সময় কাজী আরেফ আহমেদ আততায়ীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। হামলাকারী সন্ত্রাসীরা কাজী আরেফকে মঞ্চ থেকে নেমে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। একপর্যায়ে কাজী আরেফকে তারা প্রচণ্ড গালাগাল করেন। তখন কাজী আরেফ খুনিদের অনুরোধ করে বলেন, ‘তোমরা আমাকে মার। কোথায় যেতে হবে বলো আমি যাচ্ছি। কিন্তু অন্যদের মেরো না।’ এরপরে চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা কাজী আরেফকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। তিনটি বুলেট লাগে তার শরীরে। একটি গুলি মাথার ডান দিক দিয়ে ঢুকে অপরদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। মঞ্চের ওপর পড়ে যান তিনি। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এভাবেই সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে নিহত হন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম রুপকার জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, জেলা জাসদের দুই নেতা লোকমান হোসেন ও অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলীসহ পাঁচ জাসদ নেতা।

সেদিনের সেই সমাবেশ পরিচালনাকারী আমলা সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্র নেতা কারশেদ আলম (মামলার প্রধান সাক্ষী) এবং অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সেই বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনায় চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের এমন চিত্র বেরিয়ে আসে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সে সময় পুরো দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনার রাতেই খুলনা রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি লুৎফুল কবিরসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সুরতহাল রিপোর্ট শেষে রাতে নিহতদের লাশ দৌলতপুর থানায় রাখা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য পরদিন সকালে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে নিজ নিজ এলাকায় নিহত জাসদ নেতাদের দাফন করা হয়। ওই বছরই চরমপন্থি অধ্যুষিত এ উপজেলার কালিদাসপুর ও শ্যামপুরসহ আরো কয়েকটি স্থানে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এসব পুলিশ ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন।

মামলার সবিস্তার : দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দৌলতপুর থানার তখনকার ওসি ইছাহাক আলী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় প্রাথমিকভাবে ২৫ জনকে আসামি করা হয়। এর কিছুদিন পর চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডির ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়। সিআইডি তদন্তভার গ্রহণ করার পর তারা দৌলতপুর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লাকে বহুল আলোচিত এ মামলায় জড়িয়ে তাদের দুজনকেও আসামি করে। তবে মামলাটির রায় ঘোষণার আগেই হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ বিএনপি নেতা রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা ও সাবেক ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লাকে মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেন। সিআইডির ইন্সপেক্টর নবকুমার দাস দীর্ঘ তদন্তের পর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলে হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়া আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে ১০ জনকে ফাঁসি, ১২ জনকে যাবজ্জীবন ও তিনজনকে খালাস প্রদান করা হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, ইলিয়াস হোসেন ওরফে এলাচ, রাশেদুল ইসলাম ওরফে ঝন্টু, সাফায়েত হোসেন হাবিব, আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু, শহিরুদ্দিন, মান্নান মোল্লা, বাকের উদ্দিন, রওশন জাহান, জাহান আলী ও জালাল উদ্দিন। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, রাফাত ওরফে রাফা, গারেস, তাসিরুদ্দিন, আসগর জোয়ারদার, নজরুল ইসলাম, ওয়ালিউর রহমান, একুব্বার, টিক্কা ওরফে জাব্বার, লাবলু, ফিরোজ ওরফে ফরু, লাল্টু ওরফে নুরুজ্জামান।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করলে ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট আদালত একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১২ আসামিকে মামলা থেকে খালাস দেন। এরপর খালাসপ্রাপ্ত সব আসামির বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। পাশাপাশি কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামি রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু ও আনোয়ার হোসেন খালাস চেয়ে লিভ টু আপিল করেন। আবেদনগুলোর শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৭ আগস্ট আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল নিষ্পত্তি করেন। হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় রাশেদুল ও আনোয়ারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এরপর আসামি রাশেদুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন রিভিউ আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। এ নিয়ে এই মামলায় মোট ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। আপিলের রায়ে হাইকোর্ট যাবজ্জীবনপ্রাপ্তদের দণ্ড থেকে খালাস দেয়ার পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শহিরুদ্দিনকেও খালাস দিয়ে দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিদের দণ্ড কার্যকরের অনুমতি দেন হাইকোর্ট। আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টুর পুনর্বিবেচনার আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল আপিল বিভাগ দণ্ড কার্যকরে স্থগিতাদেশ দেন। ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর রিভিউ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন।

এ হত্যা মামলায় ৯ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে ২০১৬ সালের ৯ জানুয়ারি যশোর কারাগারে বন্দি তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ওইদিন গভীর রাতে যে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় তারা হলেন, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুর্শা গ্রামের মৃত উম্মত আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন, একই উপজেলার রাজনগর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে সাফায়েত হোসেন ওরফে হাবিব ও দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের ছেলে রাসেদুল ইসলাম ঝন্টু। মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অপর পাঁচ আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন, এ উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের পচাভিটা গ্রামের মান্নান মোল্লা, একই ইউনিয়নের বালিয়াশিসা গ্রামের হারেজ উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন, দৌলতপুর সদর ইউনয়নের কিশোরীনগর গ্রামের মোজাহার উদ্দিনের ছেলে বাকের উদ্দিন, পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের মেহেরনগর গ্রামের রমজান আলীর ছেলে জাহান আলী এবং মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার নায়েব মণ্ডলের ছেলে রওশন জাহান। এছাড়া কারাগারে থাকা অবস্থায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি ইলিয়াস হোসেন ওরফে এলাচ মারা গেছেন।

এদিকে বহুল আলোচিত কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা হত্যার ২১তম বার্ষিকী উপলক্ষে দৌলতপুর উপজেলা জাসদের পক্ষ থেকে রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) উপজেলার ফিলিপনগর হাইস্কুল মাঠে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া শহীদ ইয়াকুব আলী স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে তার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠানের কর্মসূচি রয়েছে।