চাপ বাড়াতে ‘জিম্মি’ কৌশল অবলম্বন করছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা

সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের ঘোষণা দেয়ার পরই নানা টালবাহান শুরু করে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। নতুন আইন সংশোধনের দাবি তুলে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ খুঁজছে তারা। সোমবার থেকে আইন কার্যকরের পূর্ব ঘোষণা থাকায় সকাল থেকেই সড়কে গাড়ির সংখ্যা ছিল কম।

বিভিন্ন অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করার বিরোধিতায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় এরই মধ্যে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। গতকাল সকাল থেকে তাদের আকস্মিক এই কর্মসূচির কারণে ভোগান্তিতে পড়েন দূরপাল্লার যাত্রীরা। অনেকেই বাসস্ট্যান্ডে এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ফিরে যান।

যাত্রী সাধারণকে জিম্মি করে পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের এ ধরনের কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রথম দিন সোমবার বেলা ১১টা থেকে রাজধানীর ছয়টি স্থানে মোট আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৮৮টি মামলা ও জরিমানা আদায় করা হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।

অবশ্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কোনো চাপেই নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের পথ থেকে সরকার সরে আসবে না। একই সঙ্গে এই আইন প্রয়োগে যেন অযথা বাড়াবাড়ি না হয় সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, নতুন সড়ক পরিবহন আইন ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হলেও সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ শুরু করেছে বিআরটিএ। প্রথম দিন সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে ৮টি পৃথক ভ্রাম্যমাণ আদালত সারাদিনে মোট ৮৮টি মামলা দায়ের করেছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৯০০ টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) আদালত-৮ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনীন বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। প্রথম দিন হিসেবে জরিমানার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রয়োগ না করে সচেতনতার জন্য আইনের মধ্যে থেকেই কম জরিমানা করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, জরিমানা ও মামলা করার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অধিকাংশ যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন বা কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ফিটনেস নেই, সংরক্ষিত সিটের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমোদিত সিটের বাইরে অতিরিক্ত সিট বসানো হয়েছে। ভাড়ার তালিকা নির্ধারিত স্থানে নেই। চালকের ক্ষেত্রে লাইট (হালকা) লাইসেন্স নিয়ে ভারী যানবাহন চালাতে দেখা গেছে, যা নতুন আইনের ব্যত্যয়। তাই মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে।

মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বিপরীত লেনে ভ্রাম্যমাণ আদালত-৭ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, অভিযানে নতুন আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে গাড়ির ফিটনেস না থাকা, ট্যাক্সটোকেন না থাকা, হালকা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ভারী পরিবহন চালানোয় মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে।

বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) এ কে এম মাসুদুর রহমান বলেন, নতুন আইন গত ১ নভেম্বার কার্যকর হলেও সোমবার থেকে প্রায়োগিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিআরটিএ। গত ১৮ দিন জনসচেতনতার জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। প্রথম দিন রাজধানীর উত্তরা, বনানী, মতিঝিল, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় মোট ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।

এদিকে ঢাকার রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসার খবরে সকাল থেকে সড়কে গাড়ি ছিল কম। এতে জনসাধারণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই সুযোগে কয়েকগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দেয় রিকশাচালকরা। বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, যেসব পরিবহনের কাগজপত্র ঠিক নেই, ফিটনেসের সমস্যা রয়েছে কিংবা চালকের কাক্সিক্ষত মানের লাইসেন্স নেই, তাদের অধিকাংশই সড়কে যানবাহন নামাননি।

জরিমানা কিংবা জেলের ভয়ে সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম দেখা গেছে। গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর ফার্মগেট, খামারবাড়ী, মানিকমিয়া এভিনিউ, আসাদগেট কলেজগেট, শ্যামলী এলাকায় আগের তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল কম। এ জন্য ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী সাধারণ। ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা সিএনজির সংখ্যাও অন্যান্য দিনের তুলনায় কম দেখা যায়।

শ্যামলীর বাসিন্দা শাকিল খান কলেজগেট এলাকায় সিএনজিতে ওঠার আগ মুহূর্তে বলেন, বাংলামোটর যাব। কিন্তু শ্যামলীতে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থেকেও যানবাহন পাচ্ছিলাম না। গণপরিবহন থাকলেও গেট লক করা। সিটের অতিরিক্ত যাত্রীও নিচ্ছে না বাসগুলো। বাধ্য হয়ে হেঁটে কলেজগেট এলাম। এখানেও বাসে উঠতে না পেরে সিএনজি ধরে রওয়ানা দিচ্ছি।

আরো পড়ুন:
সুনামগঞ্জে লবণের দাম বৃদ্ধি, গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জেলা প্রশাসনের
মেসির শেষ সময়ের গোলে জয় আর্জেন্টিনার

আসাদগেট এলাকায় বাসের অপেক্ষায় থাকা মোহাম্মদপুর টিপু সুলতান রোডের বাসিন্দা জাহানারা বেগম বলেন, এমনিতে দিনে সড়কে দাঁড়ানো যায় না। গাড়িতে ঠাসা থাকে সড়ক। শব্দে টেকা যায় না। আজ সে রকম কিছু মনে হচ্ছে না। সড়কে গাড়ির সংখ্যা যেন অর্ধেকে নেমেছে।

আসাদগেট এলাকার ট্রাফিক সদস্য রেজাউল জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুক্র-শনিবার ছাড়া সার্বক্ষণিক চাপ থাকে এই এলাকার সড়কে। কিন্তু গতকাল সোমবার বিশেষ চাপ ছিল না। সব ধরনের পরিবহন কম লক্ষ্য করা গেছে। নতুন আইনের প্রয়োগে জরিমানা ও মামলা এড়াতেই গাড়ির সংখ্যা সড়কে কমেছে বলে মনে করেন তিনি।

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায় ঘোষণা ছাড়া সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বাস বন্ধ রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির চিত্র। খুলনা বিভাগীয় শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক মোর্তজা হোসেন বলেন, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার পরিবহন শ্রমিকরা সকাল থেকে ‘স্বেচ্ছায়’ কর্মবিরতি পালন করছেন। তার দাবি, শ্রমিকরা কাউকে ইচ্ছা করে হত্যা করে না। অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জন্য নতুন সড়ক আইনে তাদের ঘাতক বলা হচ্ছে। তাদের জন্য এমন আইন করা হয়েছে, যা সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি বলেন, নতুন আইনের অনেক ধারার ব্যাপারে শ্রমিকদের আপত্তি রয়েছে। সরকার সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় শ্রমিকরা বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন।

যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশিদ জানান, ১৪ নভেম্ব^র যশোরে এক সমাবেশ থেকে ২০১৮ সালের সড়ক আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। এরপর রবিবার থেকে যশোরের ১৮ রুটের শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করেন। পরে গতকাল সকাল থেকে অন্যান্য জেলাতেও কর্মবিরতি শুরু হয়।

খুলনা, যশোর-বেনাপোল ও যশোর-সাতক্ষীরার অভ্যন্তরীণ রুটে কোনো যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করলেও ঢাকা-কলকাতা ও বেনাপোল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থানে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। এ ছাড়া প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, নসিমন-করিমন জাতীয় ছোট যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ঝিনাইদহে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার চালকরাও কর্মবিরতি পালন করছেন। গতকাল সকাল থেকে ঝিনাইদহ-যশোর, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ-মাগুরা, ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ-হাটফাজিলপুর ও ঝিনাইদহ-হরিণাকুণ্ডু রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাস না পেয়ে অনেকে ইজিবাইক ও মহাসড়কে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহনে চলাচল করছেন। স্থানীয় সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও ঢাকাসহ দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে।

ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. হামানুজ্জামান গতকাল দুপুরে বলেন, শ্রমিকদের অঘোষিত কর্ম বিরতিতে লোকাল রুটগুলোতে বাস, মিনিবাস চলছে না। তবে দূরপাল্লার রুটে যানবাহন চলাচল করছে।

প্রসঙ্গত, গত বছর ঢাকায় বাসচাপায় দুই ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস হয়। বেপরোয়া মোটরযানের কবলে পড়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এ আইনে, যা আগের তুলনায় বেশি। এ কারণে আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো।

নভেম্বর ১৯, ২০১৯ at ১১:৪৩:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/ভোকা/এএএম