দুই-একটি দোকানে স্যালাইন মিললেও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ বেশি দাম

‘স্যালাইনের সংকট কৃত্রিম উপায়ে তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেছেন। তার এমন দাবির পর রবিবার কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সরকারিভাবে স্যালাইন সরবরাহে তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হলে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ সংকট কেন, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন এই প্রতিনিধি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের ইনজেকটেবল স্যালাইন সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু গত সাত মাসের বেশি সময় ধরে চাহিদার তুলনায় খুব অল্প পরিমাণ স্যালাইন দিয়েছে তারা। কিছু স্যালাইন একেবারেই দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
রোগীরা বলছেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে স্যালাইন পাচ্ছেন না। বাইরে থেকে কিনতে গেলেও সহজে মিলছে না। দুই-একটি দোকানে মিললেও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ বেশি দাম।
‘হাসপাতাল আর পৌর বাজার এলাকা ঘুরে কোথাও স্যালাইন পাই নাই। একটা দোকানে পেলেও অন্য ওষুধ না নেওয়ার কারণে তা দেয়নি। পরে শহরের শেষ মাথায় পুরাতন পশু হাসপাতাল মোড়ের একটি ফার্মেসি থেকে স্যালাইন কিনেছি। তাও নির্ধারিত দামের বেশি দিয়ে। আমাদের এই অবস্থা। পরিস্থিতি কেমন চলছে বুঝুন তাহলে। ঘুরে ফিরে আমরা ভুক্তভোগী।’ রবিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের বারান্দায় অসুস্থ বন্ধুর পাশে বসে এভাবেই স্যালাইন নিয়ে ভোগান্তির কথা জানালেন স্নাতক প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী আজিজুল হক।
পাশে চিকিৎসাধীন বন্ধু তরিকুলকে দেখিয়ে আজিজুল বলেন, ‘হাসপাতালে আনার পর স্যালাইন ও ওষুধ লিখে দিয়ে কিনে আনতে বলা হয়। হাসপাতালে নাকি স্যালাইন নাই। সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন থাকবে না, এটা সত্য নাকি মিথ্যা কে জানে।’ তরিকুলের শরীরে তখন লিবরা কোম্পানির ‘লিবোট’ স্যালাইন পুশ করা।
পাশেই মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজারহাট থেকে আসা আহসান হাবীব। তার শরীরে তখন ওরিয়ন ফার্মার ‘ডেক্সট্রোসাল’ স্যালাইন চলছে। তিনিও হাসপাতাল থেকে স্যালাইন পাননি। দুই দিন ধরে অতিরিক্ত দাম দিয়ে এই স্যালাইন কিনে নিতে হচ্ছে বলে জানান হাবীব।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে চার শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। বেশিরভাগ রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি দিতে হয় ডিএনএস (ডেক্সট্রোজ + সোডিয়াম ক্লোরাইড), ডিএ (ডেক্সট্রোজ অ্যাকোয়া), হার্টম্যান সলিউশন ও নরমাল স্যালাইন। এসব স্যালাইন এমএসআর (মেডিসিন ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ক্রয়) টেন্ডারের মাধ্যমে কেনার কোনও সুযোগ নেই।
নির্দেশনা অনুযায়ী ইডিসিএল থেকে কিনতে হয়। কিন্তু ইডিসিএল সাত মাস ধরে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন দিতে পারছে না। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর সাড়ে ছয় হাজার পিস চাহিদার বিপরীতে ডিএনএস স্যালাইন দিয়েছে মাত্র ৩০০ পিস। নরমাল স্যালাইন পাঁচ হাজারের বিপরীতে ৫০০, হার্টম্যান সলিউশন পাঁচ হাজারের বিপরীতে তিন হাজার পিস দিয়েছে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে দুই ধাপে পাওয়া স্যালাইনের মধ্যে ডিএ স্যালাইন পাওয়া যায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে রোগীদের বাইরে থেকে এই স্যালাইন কিনতে বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্যালাইনের বিশেষ করে ডিএনএস ও নরমাল স্যালাইনের যে সরবরাহ পাওয়া গেছে, তা দিয়ে হাসপাতালের দুই দিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব। কয়েক মাস ধরে হাসপাতালে ডিএ স্যালাইনের কোনও মজুত নেই। এজন্য বেশিরভাগ রোগীকে বাইরে থেকে কিনতে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাইরেও সংকট। কোম্পানিগুলো স্যালাইন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে রোগীদের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ।
সংকটের কথা স্বীকার করে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শাহীনুর রহমান সরদার বলেন, ‘ইডিসিএল থেকে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না। আবার আমরা এমএসআর টেন্ডারের মাধ্যমে কিনতেও পারছি না। ফলে হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট চলছে। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
জেলার ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উৎপাদনকারী সব কোম্পানি গত কয়েক মাস ধরে স্যালাইনের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কয়েকটি কোম্পানি সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। কেন রেখেছে, তা বলতে পারছেন না ওষুধ ব্যবসায়ীরা।
ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, কোম্পানি থেকে স্যালাইনের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরিয়ন ইনফিউশন ও অপসো স্যালাইনের বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে সংকটের সত্যতা মিলেছে।
অপসো স্যালাইনের বিক্রয় প্রতিনিধি রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্যালাইনের তীব্র সংকট চলছে। মাঝেমধ্যে অল্প পরিমাণ সরবরাহ পাচ্ছি আমরা। কেন সংকট, তা বলতে পারবো না। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আমরা জানি না। এটা কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’
জেলার সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্যালাইন সংকট চলছে। রোগীরা সরকারি এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্যালাইন পাচ্ছেন না।
সংকটের কথা উল্লেখ করে জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো.মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ বলেন, ‘স্যালাইন সংকট চলছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সবখানে সরবরাহ সংকট। কেন সংকট, তা জানি না।’
সরকারি হাসপাতালে সরবরাহে সংকটের কারণ জানতে রবিবার বিকালে বগুড়ার থানথনিয়া ইডিসিএল অফিসে ফোন করলে অপর প্রান্ত থেকে কোনও সাড়া মেলেনি।
দেশদর্পণ/সুআ/নদা/ইর