দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে।

দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে।এ নিয়ে সমাজের সচেতন মহল হতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।গত মে মাসেই দেশের প্রথম সারির তিন বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট,রুয়েট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা নতুন করে ভাবাচ্ছে সবাইকে।এতসব আত্মহত্যার ঘটনার পরও উচ্চশিক্ষার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই নেই শিক্ষার্থীদের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে করা হয় না তেমন কোন কাউন্সিলিং।

গতবছর শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়,আত্মহত্যাকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ।আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।সেবছর শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আঁচল ফাউন্ডেশন বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনাও করেন। আত্মহত্যার কারণ ও এর প্রতিকার বা সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোঃফরিদ হাসান।

বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলছে। বলে রাখা জরুরী এই আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পাঠ্যক্রম জীবন-মুখী নয়। অথ্যাৎ জীবনকে সুন্দর করে দেখার যে প্রবনতা বা দৃষ্টিভঙ্গি সেটা তৈরী করে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক প্রকার ব্যর্থ বলা চলে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে অভিভাবক সূলভ আচরন থাকা দরকার সেটাও বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বহন করে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ঔপনিবেশিক আচরণে নিজেদের ব্যস্ত করে তোলে। যার কারণে একজন শিক্ষার্থী দুপুরে সুলভ মূল্যে ঠিক মত খেতে পারবে কিনা কিংবা হলে পড়ার মত পরিবেশ আছে কিনা সে দিকে মনোযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রুপ নিয়েছে সেলুন কিংবা বিউটিপার্লারের ভূমিকায়। যেটা একটা দেশের জন্য লজ্জাকর। তাছাড়া একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবন শেষে পেশাগত জীবনে ঠিক কোন দিকে যাবে সেই বিষয়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোন ধরনের দিকনির্দেশনা লক্ষ্য করা যায় না। যার ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হতাশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে তাদেরই কেও কেও আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ দিকে পা বাড়ায়। আমি মনে করি এই আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ সমস্যা থেকে কাটিয়ে উঠার জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর আরো বেশি মানবিক হয়ে উঠা উচিত ৷ একই সাথে একজন ছাত্রের পেশাগত জীবন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক দিক নির্দেশনা সরবরাহ করা৷ পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি আনন্দায়ক এবং জীবনমুখি হিসেবে তৈরী হলেই এই সমস্যা সমাধান হবে বলে আমি মনে করি৷
মো. মাজেদ হোসাইন মাহি
বাংলা বিভাগ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

আত্মহত্যার চিন্তা জটিল ও বহুমাত্রিকঃ
আত্মহত্যার চিন্তা জটিল এবং যেসব কারণ আত্মহত্যার দিকে পরিচালিত করে তা আরও জটিল ও বহুমাত্রিক। কোনো একক কারণ সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যেমন উদ্বেগ এবং বিষণœতাও এক্ষেত্রে অবদান রাখে। আমরা যা জানি তা হলো যে কিছু নির্দিষ্ট কারণ এবং জীবনের ঘটনা আছে, যা কাউকে আত্মহত্যার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। সামাজিক কারণগুলো হতাশা এবং মানসিক অসুস্থতার জন্য দায়ী। সুতরাং সামাজিক কারণগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা সংঘটনের জন্য দায়ী। আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এক দিনে এই ভয়ংকর মানসিক ব্যাধির সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে সরকারের নানান পদক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার আশা জাগছে। এর মধ্যে একটি হল মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন।আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষক এবং বাবা মায়েদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশে সকল স্তরের শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুকালে বাচ্চাদের উপর বাবা মায়ের প্রভাব যেমন বেশি থাকে, কৈশোরে সেই দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষকদের উপর। তাই শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনে তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যও বেশি।কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা, বেকারত্ব হ্রাস ইত্যাদি পদক্ষেপ নিলে অনেকটাই স্বাভাবিক হবে।

মুরাদ হোসেন
রসায়ন বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,দিনাজপুর।

বাংলাদেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে কেন?
স্কুল-ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সম্পর্কে ব্যর্থ হওয়া এবং আর্থিক সংকটের কারণেই বেশি আত্মহত্যা করে থাকে।কিন্তু স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এই পথ বেছে নেয় পরিবারের সমস্যদের উপর মান-অভিমানের কারণে। কেউ হয়তো মোটরসাইকেল কিনতে চেয়েছে, সেটি না পেয়ে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ হয়তো গেমস খেলতে চেয়েছে, তাকে বারণ করায় আত্মহত্যা করেছে। এ বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার দ্বিতীয় বড় কারণ হচ্ছে প্রেমঘটিত। প্রায় ২৩ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে প্রেমঘটিত কারণে।এছাড়া পারিবারিক কলহ, হতাশা, মানসিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে প্রকাশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে না পারা, পড়াশুনার চাপসহ নানা কারণ রয়েছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে।পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে না পারলেও অনেকে আত্মহত্যা করে পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে না পারলেও অনেকে আত্মহত্যা করে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ সময়ে একটা ক্ষণিকের সিদ্ধান্তেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে ফেলছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনার অংশ নয়।সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে পরিবারের সদস্যদের সাথে মান-অভিমানের জেরে।রাগারাগি হলে ওই সময়ে তীব্র অভিমানকে সামাল দিতে না পারলে তার মনে হয় যে, মৃত্যুই হচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার একটা পথ।“এক্ষেত্রে বেশিরভাগই কিন্তু এদের মধ্যে হলো চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতাটা কম বা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কম।

তানজিলা আক্তার লাবণী,
সরকারি এমএম কলেজ,যশোর।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে ।সম্প্রতি বুয়েট , রুয়েট ও চবির শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা আমরা জানি । আপনাদের কী মনে হয় এ ধরনের কাজের কারণ কি ও এ সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় বা সমাধান কি হতে পারে ?প্রথমত, একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? সে আত্মহত্যা করে ভালো থাকার জন্য। এই পৃথিবীতে কেউ খারাপ থাকতে চাই না। যে আত্মহত্যা করে সে মূলত নিজেকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চাই। কিন্তু আত্মহত্যা করলে কী আসলেই ভালো থাকা যায়? উত্তর: না।
সম্প্রতি আমরা আত্মহত্যার ঘটনা গুলো দেখলাম, তারা সবাই খুব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বলা যেতে পারে তারা সফলতার অর্ধেকের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। তারপরও তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কেন? এই প্রশ্ন কম বেশি আমাদের সবারই। আত্মহত্যার কারণ মূলত না পাওয়া, অসন্তুষ্ট থাকা নিজের জীবন নিয়ে। আপনাকে যদি প্রশ্ন করি আপনার না পাওয়া সবকিছু যদি আপনাকে দেওয়া হয় তাহলে কী আপনি সুখী হয়ে যাবেন? কখনোই হতে পারবেন না। কারণ মানুষের চাহিদা অনন্ত। সুখ পেতে গেলে আপনাকে সবার আগে সন্তুষ্ট হতে হবে। ধৈর্য ধারণ মানবজীবনের অনেক বড় একটা গুণাবলী। এক পশলা বৃষ্টির পর যেমন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়, ঠিক তেমন খারাপ সময় কেটে যাবে।

কবির কথায় –
মেঘ দেখে করিস না ভয়,
আড়ালে তার সূর্য হাসে।

খারাপ সময়ে সাহস রেখে চলতে হবে। নিজেকে বলতে হবে এই সময় কেটে যাবে। হেরে যাওয়ার আগে যারা হার মেনে নেয় তারাই আত্মহত্যা করে। যারা জীবনে একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, তারা ভাবুন তো সেদিন যদি হার মেনে নিতেন তাহলে কী আজকের সুন্দর একটি দিন দেখতে পেতেন? সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ধৈর্যশীল মানুষেরা কখনো হার মানে না। তারা আত্মহত্যা করে না।

জান্নাতুল আক্তার অত্রী
পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

জুন ২০,২০২৩ at ১৪:১৬:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/শাস