দুর্গোৎসব পালনে যশোরের ৭ শতাধিক মন্ডপে চলছে সাড়ম্বর আয়োজন

শরৎ শুভ্রতায় চারিদিকে শুধু সাজ সাজ রবে উৎসবের আমেজ। শরতের নীল-সাদা আকাশ, ভোরের আবছা কুয়াশা, শোভা পাচ্ছে কাঁশফুল আর বাতাসে শেফালী ফুলের ঘ্রাণ। প্রকৃতির এ শোভনীয় রূপের মোহনীয় মুহূর্তে জানান দিচ্ছে অশুভনাশিনী আনন্দময়ী দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। আর কাশফোটা শরতের শারদীয় এ দূর্গোৎসবকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে সারাদেশের মত যশোরাঞ্চলের প্রতিমা শিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। শিল্পীর কল্পনায় দেবী দূর্গার অনিন্দ্যসুন্দর রূপ দিতে দিন রাতভর করছে প্রতিমা তৈরির কাজ।

আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্যে দিয়ে ঢাক-ঢোল আর কাঁসার বাদ্যে শুরু হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। তাই দেবীর আগমনকে ঘিরে ব্যস্ত যশোরের প্রতিমা কারিগররা। প্রতিমা তৈরি দেখতে মন্দির ও মন্ডপেও আসছে অনেকেই। এবার যশোর জেলার ৮ উপজেলার ৭০২টি পূজা মন্ডপে হবে এ দুর্গোৎসব। জেলা প্রশসান ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে মন্ডপগুলোতে।

এদিকে, যথাযথ মর্যাদা ও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজার আয়োজনে প্রস্তুতি সভা করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে কালেক্টরেটের অমিত্রাক্ষর সভাকক্ষে গত সপ্তাহে সমাগত শারদীয় দুর্গাপূজা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে এ প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সভায় জানানো হয়- পূজা মন্ডপগুলোতে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মনিটরিং টিম কাজ করবে। উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে দুর্গাপূজা আয়োজনের লক্ষ্যে সব রকমের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এই লক্ষ্যে প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা বাহিনী সমন্বিতভাবে দায়িত্ব পালন করবে।

অন্যদিকে, সামর্থ্য অনুযায়ী স্থানীয় ও অন্য জেলা থেকে কারিগর এনেও প্রতিমা তৈরি করছেন পূজার আয়োজকরা। যশোর শহরের বেজপাড়া পূজা সমিতি মন্দিরে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে প্রতিমার কাজ প্রায় অধিকাংশই শেষ। কারিগররা জানান, বেনার (খড় দিয়ে কাঠামো) কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কোথাও কোথাও বেনায় মাটির প্রলেপ দেয়াও শেষ। এখন শুকানোর অপেক্ষা। আবার কোথাও কোথাও রঙ আর তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে দেবীর প্রতিচ্ছবি। সব মিলিয়ে ইতিমধ্যে প্রতিমা তৈরির প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

বেজপাড়া পূজা সমিতি মন্দিরের প্রতিমা শিল্পী জয়দেব পাল জানান, মূলত প্রতি বছর রথযাত্রার পর থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন ধরনের প্রতিমার ক্যাটালগ দেখে আয়োজকরা তাদের বায়না করেন। সেই অনুযায়ী চলে প্রতিমা তৈরির কাজ। দুর্গা প্রতিমার পাশাপাশি গণেশ, কার্তিক, লক্ষী ও সরস্বতীর প্রতিমাকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে হয়। মহিষাসুর, সিংহসহ সবার বাহনও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

তাই সেগুলোকেও দিতে হয় সমান গুরুত্ব। আর এসব মিলিয়েই পরিপূর্ণ হয় একটি প্রতিমা। এই পুরো কাজটি কোনো একক কারিগরের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাঠামোতে বেনা বাঁধা, প্রতিমার চোখ, হাতের আঙুল, মুখমন্ডল তৈরিসহ প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন কারিগর। এই একটি প্রতিমার কাজ সম্পূর্ণ করতে ৫/৬ জন করিগরের সময় লাগে ১৫ দিন।

তিনি আরও বলেন, সারঞ্জমের দাম অন্য বছরের তুলনায় বেশি হওয়ায় এবার প্রতিমা তৈরিতে খরচ বেশি পড়ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকে জানিয়েছেন, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে নানা ধর্মীয় মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের শুরু। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর মহাপঞ্চমী, ১ অক্টোবর সকালে ষষ্টাদি কল্পারম্ভে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস, ওই দিন বিকেলে পূজারম্ভ।

২ অক্টোবর সকালে মহাসপ্তমি, ৩ অক্টোবর সকালে মহা অষ্টমী; এদিন যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রমে কুমারীপূজা সকাল ১১টায়। ৪ অক্টোবর সকালে মহানবমী পূজা কল্পারম্ভ এবং ৫ অক্টোবর সকালে মহাদশমী কল্পারম্ভ-পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন। এবছর দেবীর আগমন গজে; যার অর্থ শস্যপূণ্যা বসুন্ধরা এবং কৈলাসে ফিরে যাবেন নৌকায়।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার ঘোষ জানান, এ বছর যশোর জেলার ৮ উপজেলায় ৭০২ টি মন্ডপে পূজা উৎসব হবে। গত বছরের তুলনায় এবছর ৪টি পূজা মন্ডপ বেড়েছে। সদর উপজেলায় ১৫২টি, ঝিকরগাছায় ৬৬টি, মণিরামপুরে ৯১ টি, কেশবপুরে ৯৬টি, চৌগাছায় ৫০টি, বাঘারপাড়ায় ৯০টি, অভয়নগরে ১২৮টি, শার্শার ২৯টি মন্দির-মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীপংকর দাস রতন জানান, এখন প্রতিমা কাজ শেষের দিকে। কোথাও কোথাও চলছে রং তুলির কাজ, এরপর সাজসজ্জার কাজ করা হবে। সব পূজামন্ডপে যথাসম্ভব সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। পুলিশ, আনসারের পাশাপাশি নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রাখা হবে। তারা পুলিশ, আনসারের পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কাজ করবে।

জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য রাজনীতি থাকে। এছাড়া ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের দ্ব›দ্বও ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সংঘাত সৃষ্টি করা নয়; আমাদের উদ্দেশ্য সম্প্রীতি, শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা করা। আমরা শংকিত বা আতঙ্কিত নই; তবে আমরা সতর্ক। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে; সতর্ক থাকার কোন বিকল্প নেই। কারণ ষড়যন্ত্র হয়; সামাজিক- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র অতীতেও হয়েছে; এখনও তা চলমান।’

তিনি বলেন, আমরা এই জেলায় সাম্প্রদায়িক কোন সহিংসতা ঘটতে দেইনি; এমন দুর্ঘটনা ঘটেওনি। তারপরেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি সকলকে গুজবে কান না দেয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সতর্ক ও সচেতনতার সাথে ব্যবহার করার আহ্বান জানান।

সেপ্টেম্বর ১৮,২০২২ at ২২:২২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ /আক /মদ /শই