সরিষা ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগে মরছে মৌমাছি

সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার প্রতিটি মাঠে মাঠে এখন সরিষা ফুলে ছেয়ে গেছে। পুরো মাঠ যেন ঢেকে আছে হলুদের চাঁদরে। সরিষা ক্ষেতে গুন গুন শব্দে মৌমাছিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে। আর মধু সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মৌ খামারিরা।

মধু সংগ্রহের ঠিক সময়ে অসচেতনভাবে সরিষা ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করছে কৃষকেরা। এতে কোটি কোটি মৌমাছি মারা যাওয়ায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মৌ খামারীরা।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে ৫৪ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৪৯ হাজার ৫০০ হেক্টরে। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ বেশি হবে, এমটাই আশা করছে কৃষি অফিস।

কৃষকদের সচেতনতার অভাবে এই কীটনাশক ব্যবহারে ২ হাজার টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ভেস্তে যেতে বসেছে। মৌমাছি মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করে কৃষি বিভাগ বলছে কৃষকদের সচেতনতায় মাঠে নেমেছে তারা।

জেলার উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও শাহজাদপুরে সরিষা ফুল শেকে পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে এসেছে প্রায় ৫ শতাধিক খামারি। প্রতিবছর খামারিরা এসকল স্থান থেকে মধু সংগ্রহ করে। এবারও ২ হাজার টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে মাঠে বসিয়েছেন মৌ বাক্সগুলো। সরিষা ফুল থেকে পোষা মৌমাছি দিয়ে প্রতিবছর কয়েকশ’ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করা হয়।

যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। সম্ভাবনাময় এই খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক হাজার বেকার যুবকের। কিন্তু এ বছর সরিষা চাষীরা ক্ষেতে ফলন বাড়ানোর আশায় ভিটামিন জাতীয় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ শুরু করেছে।

সচেতনতার অভাবে একজনের দেখাদেখি অপর কৃষকও সরিষা ক্ষেতে অধিক ফলনের আশায় এই কীটনাশক স্প্রে করছে। এতে ফুল থেকে মধু সংগ্রহের সময় খামারিদের মৌমাছি মারা যাচ্ছে। এর ফলে মধু সংগ্রহে ব্যঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।

উল্লাপাড়া উপজেলার আলী গ্রামে আশার আলো মধু খামারী আব্দুর রশিদ জানান, এ বছর সরিষার জমির পাশে মধু সংগ্রহের জন্য ৩৫০টি মৌ বাক্স বসিয়েছি। সেখানে ১০ দিন ধরে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন জমির মালিকেরা। এতে সরিষার ফুলে মধু সংগ্রহ করতে বসা অন্তত ১ কোটি মৌমাছি মারা গেছে।

সরিষার ফুল থেকে তাদের মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯ টন ছিলো। কিন্তু কৃষকদের সচেতনার অভাবে ভেস্তে যেতে বসেছে আমাদের স্বপ্ন। আমরা নিরুপায় হয়ে তাদের খামারের মৌ বাক্সগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন বলে খামারিরা জানান।

আরেক মৌ খামারি আফছার আলী জানান, ৪০০ মৌ বাক্স সরিষা মাঠে ফেলেছেন। প্রতিটি বাক্সে তার ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মৌমাছি রয়েছে। কৃষকদের কীটনাশক ছড়ানোর কারণে তার অন্তত ২ কোটি মৌমাছি মারা গেছে।

আরো পড়ুন :
কাহালুতে ২ দিনব্যাপী বিজ্ঞান মেলার উদ্বোধন
ঘোড়াঘাটের চারটি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পেলেন যারা

একই এলাকার খামারি মোতালেব হোসেন, আফছার আলী, আব্দুল আহাদের অবস্থা প্রায় একই রকম। এদেরও বিপুল পরিমাণ মৌমাছি কীটনাশকের কারণে মারা গেছে।

তাড়াশ উপজেলার মান্নান নগর গ্রামের কৃষক জুলমাত হোসেন জানান, সরিষার ফলন বৃদ্ধির কারনে ব্যবসায়ীদের পরামর্শে ক্ষেত্রে কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে ফলন বৃদ্ধি পাবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে তিনি স্বীকার করেন এই বালাই নাশক স্প্রে করার কারণে মৌমাছি মারা যাচ্ছে।

উপজেলার কয়ড়া ইউনিয়নের জঙ্গলখামার গ্রামের কৃষক খলিলুর রহমান বলেন, চলতি বছরে তিন বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। যদি আবহাওয়া ভালো থাকে, তাহলে বিঘা প্রতি ৮ মণ সরিষা পাওয়া যাবে। আর বাজারমূল্য ভালো থাকলে ২৪ মণ সরিষা ৫০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হবে বলেও আশাবাদী।

সরিষা চাষি জাহাঙ্গীর হোসেন, মান্নান শেখ, জাহিদ হোসেন জানান, সরিষার ফলন বৃদ্ধির জন্য ক্ষেত্রে ভিটামিন জাতীয় কীটনাশক ছিটিয়েছেন। তবে দিনের বেলায় ওষুধ ছিটানোর কারণে মৌমাছি মারা পড়েছে। কিন্তু এই কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মৌমাছিগুলো মারা যাবে এ কথাগুলো তাদের জানা ছিল না।

জেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, সরিষা ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর কারণে মৌমাছি মারা যাচ্ছে এই খবর পেয়ে জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ফসলের মাঠগুলো পরিদর্শন করেছেন। মধু খামারিদের মৌমাছি ভোর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে। বিকেলে মৌমাছিগুলো তাদের বাক্সে ফিরে যায়। কৃষকেরা বিকেলে তাদের সষিরা ক্ষেত্রে কীটনাশক ছিটালে মৌমাছির কোনো ক্ষতি হতো না।

কৃষকদের অসচেতনতার জন্য এমনটা হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ ইতোমধ্যেই জেলার বিভিন্ন উপজেলার সরিষা চাষিদের এ বিষয়ে সচেতন করতে সবধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। কৃষকদের সচেতন করতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জানুয়ারি ০৩.২০২১ at ১৭:৪০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/আরা/রারি