চলতি মাসে যশোরে ২২ দিনে ২১ জন ছুরিকাঘাত

যশোরে হঠাৎ করেই ছরিকাঘাতে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অবক্ষয়, আইনের ফাঁক-ফোকড়, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে এ অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত। তবে অবস্থার উত্তরণে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে জেলা পুলিশ। সম্প্রতি যশোরে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি কিছুটা নাজুক হয়ে পড়েছে। তবে পুলিশ বা আইন শৃংখলা বাহিনী আইন শৃংখলা উন্নতি রাখতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন সর্বক্ষণ এমনটি বলেছেন পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

যশোর জেলা শহরে চলতি মাসের ২২ দিনে (২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ২১ জন ছুরিকাঘাতের ঘটনায় আহত হয়েছে। একদিনের ব্যবধানে ছুরিকাঘাতে আহত দু’যুবক হাসপাতালে আনার পথে মারা গেছেন। শুক্রবার রাতে শহরের হুশতলা এলাকায় রাকিব সরদার এবং রোববার দুপুরে শংকরপুর এলাকায় সাব্বির হোসেন নামের ওই দু’যুবক দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর রোববার দুপুরে শহরের শংকরপুর এলাকায় সাব্বির হোসেন নামের এক যুবকের ছুরিকাঘাতে মৃত্যু হয়েছে। সন্ত্রাসীরা তার শরীরের একাধিক স্থানে ছুরিকাঘাত করে। আগেরদিন শনিবার সন্ধ্যায় শহরের শংকরপুর এলাকায় রেজাউল ইসলাম (৩৬) নামের এক যুবক ছুরিকাঘাতের শিকার হন। শংকরপুর মুরগি ফার্মের সামনে এই ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। রেজাউল শহরে শংকরপুর বীর মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজ্জাম্মেল হকের ছেলে। তিনি এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

শুক্রবার রাতে পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মীসভা শেষে বাড়িতে ফেরার সময় ছুরিকাঘাতের শিকার হন রাকিব সরদার (৩০) নামের এক যুবক। সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরন হয়ে তার মৃত্যু হয়। নিহত যুবক রাকিব বকচর হুশতলা কবরস্থানপাড়ার মৃত লিটু সরদারের ছেলে। তিনি পেশায় মোটরগাড়ি শ্রমিক ছিলেন।

আরো পড়ুন:
শেখ হাসিনার উন্নয়ন দেখে নৌকায় ভোট চাইলেন মিন্টু
চৌগাছায় ভৈরবের অবৈধভাবে পাড় কেটে ইটভাটায় মাটি বিক্রির অভিযোগ

চলতি মাসের ১১ ডিসেম্বর যশোরে পৃথক স্থানে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে দুই যুবক গুরুতর আহত হয়েছিলেন। একজন যশোর সদরের মহিদ হোসেনের ছেলে হাসিবুর রহমান (১৯) ও শহরের ষষ্টীতলা এলাকার রেজাউল করীমের ছেলে নাসির হোসেন (২৬)। তাদেরকে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এ মাসেই ৮ ডিসেম্বর শহরের বেজপাড়া এলকায় এক দম্পতিকে ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। শহরের আরএন রোড এলাকার দোকান কর্মচারী জাহিদ হাসান (২৮) ও তার স্ত্রী নুসরাত ফারিয়া (১৮) ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ছুরিকাহত হয়েছিলেন । তার আগের দিন মঙ্গলবার ছুরিকাঘাতে জখম হন আরো দুই যুবক। তারা হলেন, বাঘারপাড়া উপজেলার জয়পুর গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম আরিফ (২০) ও দয়ারামপুর গ্রামের কাছেদ আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম (২৪)। তারাও ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন।

পহেলা ডিসেম্বর জেলা যুবলীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে ছুরিকাঘাতে অন্তত ১২ জন আহত হয়। এ ঘটনায় ১০ জন গুরুতর আহতাবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আহতরা হলেন, সদর উপজেলার বিরামপুর গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে খাইরুল ইসলাম (২০), চুড়ামনকাটি গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে আকিবুল ইসলাম (১৭), মুরলি এলাকার সুফিয়ানের ছেলে রাব্বি (১৮), রুপদিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে শামীম হোসেন (১৮), ঝুমঝুমপুর গ্রামের মুরাদের ছেলে রাসেল (১৭), চাঁচড়া এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে জয় আহমেদ (১৭), ধর্মতলা এলাকার বাদল গোপালের ছেলে গোষ্ঠ গোপাল (২০), স্বপন সরদারের ছেলে সোহাগ (২১), আরএন রোড এলাকার শফি ড্রাইভারের ছেলে হ্যাপি (১৭), হামিদপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামের ছেলে টিটো (১৮)।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যশোরের (টিআইবি) সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাস বলেন, সম্প্রতি যশোরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেখানে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন সকলেই ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছেন। একাজগুলি যারা ঘটাচ্ছে আর যারা আহত হচ্ছে তাদের একটি বড় অংশই কিশোর। এধারা সারাদেশের মত যশোরেও অতীতে ছিলো। কিন্তু সম্প্রতি এটা বেশী দেখা যাচ্ছে। মূলত তিনটি কারণে এ ঘটনা বেশী ঘটছে।

টিআইবি যশোরের সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাস আরও বলেন, আইনী ফাঁক ফোকড়তো আছেই। দ্বিতীয়ত দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। বিরোধী দল নাই, রাজনৈতিক খোলা বাতায়নের দ্বার অনেকটা রুদ্ধ। আগে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক মারামারি অপর পক্ষের সাথে হতো। কিন্তু এখন সেটি নিজেদের মধ্যেই সংঘঠিত হচ্ছে। সম্প্রতি যশোরে অনুষ্ঠিত একটি বড় যুব সংগঠনের সমাবেশেও দেখেছি, নিজেদের মধ্যে ছুরিকাঘাতে ঘটনা। আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে এগুলো বেশী ঘটছে। যেখানে রাজনৈতিক আর্শীবাদ কাজ করে। ‘একজন অন্যায় করার আগেই জানতে পারে, আমার কিছু হবে না। নেতাদের আর্শীবাদের হাত আমার মাথায় আছে।’ তখন সে অন্যায় করতে আরও উদ্বুদ্ধ হয়। আমরা পাকিস্তান আমলে এমনটি দেখেছিলাম। পরে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু অতীতের মত সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে এজন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দৈন্যতাই দায়ী।

সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাস বলেন, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সমাজকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে এটি অনেক কমে যাবে। তাছাড়া আইনের ব্যাপারে দ্রুত কিছু সংশোধনী আনা উচিত। এছাড়া সন্ত্রাসী. দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপারে না লড়ার জন্য যেমন আইনজীবীদের একাট্টা হওয়া উচিত, তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, শহরের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ইতিমধ্যেই বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন উইং সমন্বয় করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। এপর্যন্ত এ ধরণের সাতটি মামলার বিপরীতে আমরা ২৫ জনকে আটক করেছি। এসময় ২৫টি ছুরিসহ আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। আশাকরছি খুব দ্রুতই যশোরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।

ডিসেম্বর ২২.২০২১ at ২০:৩৯:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/শজ/জআ