এক হাতেই সাইফুলের জীবন যুদ্ধ

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কঠিন সময় পার করতে হয়। কেউ হেরে যায়, কেউ আত্মবিশ্বাষ বাড়িয়ে, লড়াই করে এগিয়ে যায়। তবে সকল কষ্টের হানা যার জীবনে। এক হাত নিয়েই দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম। যে বয়সে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে হাসি-খুশিময় সময় কাটানোর কথা তখনো জীবিকার সন্ধানে রিক্সা চালিয়েই যাচ্ছেন তিনি।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৭৫)। তার ২ ছেলে। বড় ছেলে নুর-নবী রাজ মিস্ত্রি ও ছোট ছেলে ইউসুফ আলী এইচএসসি পাশ করে বাড়িতে বেকার হয়ে আছেন। দুই টা ছেলে থাকা সত্তেও এখনো তাকে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। প্রায় ৪০ বছর ধরে রিক্সা চালান সাইফুল ইসলাম।

প্রতিদিন কাক ডাকা ভোর বেলা উঠে এক হাত নিয়ে রিক্সা চালিয়ে সারাদিন হার ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বউ ছেলের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন এভাবেই পরিশ্রম করতে করতে বর্তমানে নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। তাই নিয়মিত রিক্সা চালাতে পারেন না। তারপরও জীবিকার তাগিদে তাকে রিক্সা চালাতে হচ্ছে।

জীবন যুদ্ধে হার না মানা সাইফুল ইসলাম বলেন, বয়স মাত্র ১২ বছর। সেই সময় গাছ থেকে পরে প্রাণে বেচেঁ গেলেও বাম হাত ভেঙ্গে যায়। সেই থেকেই জীবনে নেমে আসে জীবনের কালো অধ্যায়। কৃষক বাবার সাধ্য অনুয়ায়ী ডাক্তার ও কবিরাজকে দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন। কিন্তু ভাঙ্গা হাতে ইনফেকশনের কারনে অবশেষে চিকিৎসার মাত্র ১ মাসের মাথায় আমার বাম হাত কেটে ফেলে দিতে হয়।

তিনি আরও বলেন, হাত কেটে ফেলার কিছুদিন পরে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। তখন মা-বাবার সাথে রাজশাহী জেলায় আত্মীয়র বাড়ি চলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। বাবার সাথে স্থানীয় বাজারে কাচা-মাল বিক্রি করতে থাকি। পরে বিয়ে করি। বিয়ের ৩ বছরের মাথায় বাবা মারা যায়। বাবার মৃত্যুর কিছু দিন পরে মাও মারা যায়।

বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘরে বউ ও সন্তানদের নিয়ে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে দিন কাট ছিলো। জমি-জমা না থাকায় রিক্সা চালানো শুরু করি। এক হাত না থাকায় অনেক যাত্রী রিক্সায় উঠতো না। অনেক কষ্ট করে সংসারসহ দুই ছেলেকে বড় করেছি। এখন ছেলেরা বড় হয়েছে। তবুও রিক্সা চালানো হয়।

আরো পড়ুন :
গাজীপুরে স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ নগর পরিচিতি ও অবহিকরণ সভা অনুষ্ঠিত
পাইকগাছায় ৫ মাসে ২১ টি হারানো মোবাইল ও বিকাশের প্রায় দেড় লাখ টাকা উদ্ধার

সাইফুলের বড় ছেলে নুরনবী জানান, বাবা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে। আমাদের জমি-জমা নেই, এজন্য বৃদ্ধ বয়সে বাবা এখনো রিক্সা চালাচ্ছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত কোন সরকারী সহয়তা পায়নি আমার বাবা।

স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহাদৎ হোসেন জানান, দীর্ঘদিন এক হাতেই পা রিক্সা চালিয়েছেন সাইফুল। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ১ লক্ষ টাকা কিস্তিতে ঋণ গ্রহন করে ব্যাটারী চালিত একটি রিক্সা তৈরি করেছেন তিনি। বর্তমানে দিয়ার পাচিল, খোকশাবাড়ি, গুনের গাতী ও পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় রিক্সা চালিয়ে জীবন যাপন করছে তিনি।

খোকশাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রাশিদুল হাসান রশিদ মোল্লা জানান, সাইফুল প্রতিবন্ধী হওয়া সত্তেও ভিক্ষাবৃত্তি না করে কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। যত দ্রুত সাইফুল সহয়তা পায় সেই ব্যবস্থা করা হবে।

সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার পারভেজ জানান, আপনাদের মাধ্যমে সাইফুলের বিষয়টি জানতে পারলাম। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে সহযোগিতা করা হবে।

জেলা রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মো: মানব সরদার জানান, জেলায় প্রায় ৬ হাজারের অধিক লাইসেন্সকৃত রিকসা ও ভ্যান রয়েছে এবং লাইসেন্স ছাড়া আরও প্রায় ৯ হাজারের মতো রিকশা ও ভ্যান রয়েছে। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বয়স অনুযায়ী তার পরিবারকে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে এককালীন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়া হয়।

সেপ্টেম্বর  ১৫.২০২১ at ১২:৪৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/অরা/রারি