যমুনার চরাঞ্চলে সুইসুতায় নকশী কাঁথা তৈরীর ধুম

সিরাজগঞ্জের যমুনার চরাঞ্চলের মানুষেরা জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার তাগিদে জমি-চাষাবাদ, গরু-ছাগল পালন ও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব কাজে পুরুষদের পাশাশাশি নারীরাও ব্যাপক ভাবে অংশ নেয়। কিন্তু বয়সের কারণে অনেক নারীরা বেশি পরিশ্রমি কাজে অংশ নিতে না পারলেও বাড়িতে বসে সুইসুতা হাতে নিয়ে কাঁথা সেলাই কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন তারা। ব্যস্ত সময়ে নারীদের এই কাজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে অভাবের সংসারের দুঃখ ঘোঁচাতে সক্ষম হচ্ছেন অনেকেই। এখন চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে ধুম পড়েছে শীতের কাঁথা তৈরি করার। প্রতিটি গ্রামেই দেখা মিলবে নতুন কাঁথা তৈরি করার দৃশ্য।

কাঁথা তৈরী করা নারী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই জনপদের গ্রামগুলোতে এখন তৈরী হচ্ছে নকশি কাঁথা। বিশেষ করে গৃহস্থালীর পাশাপাশি মহিলারা অবসর সময় পেলেই সুইসুতা হাতে নিয়ে সেলাইয়ে বসেন। কেউ শখের বশে করলেও হতদরিদ্র জনগোষ্টির নারীরা সামান্য মজুরির বিনিময়ে অন্যের কাঁথা রঙ্গিন সুতায় নকশা করে সেলাই দিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়: মামুনুল হক
ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর উত্তমের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শোক

এসব কাঁথা তৈরি হয় পুরাতন কাপড় ও নানান রঙের সুতা দিয়ে। পুরোনো কাপড় কয়েক ভাঁজ করে চার দিকে সেলাই করে আটকে নেয়া হয়। তারপর সেলাইয়ের সমান দূরত্ব বজায় রেখে প্রথমে বড়-বড় ফোঁড় দিয়ে কাপড়ের চারিদিকে আটকানো হয়। তারপর নকশি সেলাই শুরু করা হয়। নকশি কাঁথার নকশিগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে, রান ফোঁড়, ডবল রান, তেরছা ফোঁড়, বৈকা ফোঁড়সহ আরো অনেক নাম। নিপুন হাতে তৈরী এসব নকশি কাঁথায় কেউ বা আবার সেলায়ের মাধ্যমে ফুটে তোলেন গ্রাম বাঙলার নানা ঐতিহ্য। সুন্দর নকশি কাঁথা তেরী করে নেয়ার পর নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি মেয়ের জামাই বাড়ীতে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দিতে পেরে নিজেকে গর্ববোধ করেন।

কাঁথা তৈরী নারী কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বড় কয়ড়া গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা প্রতিবন্ধী নুর-জাহান বেগম (৫০) বলেন, চরাঞ্চলের অনেক মানুষ ঢাকায় থাকে। সে কারনে ঢাকা শহরে থাকা অনেকেরই আতœীয় স্বজনরা আমাদের কাছে কাঁথা সেলাই করতে দিয়ে যায়। সেই কাঁথা ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরির বিনিময়ে তা সেলাইয়ের কাজ করে দিয়ে থাকেন। মাঝারি একটা কাঁথা সেলাই করতে তাদের সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ দিন।

একই গ্রামের আনোয়ারা বেগম (৪৫) বছর বয়সী স্বামী পরিত্যক্তা। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বিয়ে করে ঢাকায় গার্মেন্টর্সে চাকুরী করে আলাদা থাকেন। এখন তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বাবার বাড়ীতে। বর্তমানে তিনি কাঁথা সেলাই করে দিনাতিপাত করেন। তাদের মত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের আরও অনেক নারী শীতের কাঁথা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এখন গ্রামাঞ্চলগুলোতে চলছে শীতের কাঁথা সেলাই করার ধুম।

আবার স্পেশাল নকশি কাঁথা সেলাই করতে প্রায় ২ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। রকম ভেদে এসব নকশি কাঁথার মজুরি ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। শুধু এই চরেই না, জেলার কাজিপুর, শাহজাদপুর, সদর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের বহু বেকার নারীরা নকশি কাঁথা সেলাই করে আয় করছেন বছর জুড়ে।

তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজেদের ডাল-ভাতের পাশাপাশি ছেলে মেয়েসহ নাতি-পুতিদের জন্য শখের বায়না পূরনে ভূমিকা রাখেন। তবে নকশি কাঁথা তৈরীতে ওই সব নারীদের জন্য নেই কোন বিশেষ সুযোগ সুবিধা। প্রয়োজনের তাগিতে আজ ধরে রেখেছেন এই পেশা। কাওয়াকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম ভুঁইয়া বলেন, চরাঞ্চলের নারীরা অনেক পরিশ্রমি। এই নারীরা পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে যেকোন কাজ করতে পারেন। তবে বয়সের ভারে অনেকে ভারী কাজ করতে না পারলেও বাড়ীতে বসে কাঁথা সেলাই কাজগুলো করে বাড়তি আয় করে থাকেন।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ জানান, চরাঞ্চলের অনেক নারীরা কাঁথা সেলাই করে তাদের সংসারের অভাব দূর করছেন। তবে তারা সু-সংগঠিত হতে পারলে অবশ্যই সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া সম্ভব।

ডিসেম্বর, ০৮, ২০২০ at ১৯:০৯:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এআর/এমআরআই