হাঁসের ঝাঁকে সফলতা খামারীদের মুখে হাসি

উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালনে অভাবকে জয় করে ভাগ্য পাল্টে দিচ্ছে সিরাজগঞ্জের গ্রামাঞ্চলের অনেক গৃহবধু ও বেকার নারী-পুরুষেরা। জেলার ৯টি উপজেলায় ২৩৬ টি খামারে এখন হাঁস পালন হচ্ছে। এই খামারীদের সাফল্যে অন্যরাও উৎসাহিত হয়ে গড়ে তুলছেন ছোট-বড় খামার। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে খামার ও খামারির সংখ্যা। এই হাঁসের মাংস ও ডিম স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অপরদিকে প্রাণিজ পুষ্টির ঘাটতি পূরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে হাঁসের খামারগুলো।

বুধবার (২১ অক্টোবর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে কয়েকজন খামারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংক ঋণ ও নিজের কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াই। এদের মধ্যে নুরুল ইসলাম, মাসুদ রানা ও মরিয়ম প্রথমে ৮০০ থেকে ৯০০ পিস হাঁসের বাচ্চা ক্রয় করেন। ধীরে ধীরে বাচ্চাগুলো বড় হয়ে তিন মাস পরই ডিম দেয়া শুরু করে। কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে তাদের। বর্তমানে জেলার অনেক খামারীরা বেকারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন হাঁসের খামার করে।

উল্লাপাড়া উপজেলার খামারীদের একজন সফল প্রধান খামারীর মালিক মোঃ নুরুল ইসলাম জানান, বেকার অবস্থায় বিয়ে করায় পরিবারে অভাব অনটর ছিল নিত্যসঙ্গী। আর এ অভাবের তাড়নায় পেটের দায়ে অন্যের হাঁস-মুরগির খামারে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ২০১০ সালে নিজ এলাকায় হাঁসের খামার করার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে ৯০০ হাঁসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতার ফলে যে কোনো কাজে যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে প্রমাণ করেছেন নুুরুল ইসলাম। উপজেলার মধ্যে তিনি এখন সফল হাঁস খামারি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে তার খামারে ২ হাজার ৪০০ হাঁস রয়েছে।

কামারখন্দের আরেক সফল খামারী মাসুদ রানা জানান, হাঁস পালনের প্রশিক্ষন নিয়ে দীর্ঘ দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ৮০০ হাঁস নদীর পানিতে সফলতার সাথে পালন করছি। এই হাঁসের খামারে আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে। এখন আমার ছোট ভাইকে সরকারী চাকুরীর জন্য ১০-১২ লাক্ষ টাকা লাগবে না। সেই টাকা দিয়ে চাকুরী না করিয়ে হাঁসের খামারের কাজে লাগাবো। সেই টাকা দিয়ে যদি খামার বাড়ানো যায় তাহলে সরকারি চাকুরীজীবী ৪-৫ জন বেতনের সমমান লাভ হবে।

তিনি আরও জানান, মাত্র সাড়ে ৪ মাস বয়সেই খাকি ক্যাম্ববেল হাঁস ডিম দিতে থাকে। একটি হাস বছরে ৩০০ ডিম দিয়ে থাকে। দেশি হাঁসের তুলনায় টানা ৩ বছর পর্যন্ত খাকি ক্যাম্ববেল হাঁস ডিম পাড়ে। এ হাঁসের মাংস মুরগির মতোই পুষ্টিকর। এই হাঁস পালনে বেশি পানিরও প্রয়োজন হয় না। হাঁসের খাবার ও গলা ডোবানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পেলেই এরা সহজ ও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করে বেঁচে থাকতে পারে। হাঁস পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে এখন এলাকার অনেকেই হাঁস পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।

একই উপজেলার সফল হাঁস পালনকারী মরিয়ম বেগম বলেন, পাঁচ বছর আগে সংসারে ছেলে-মেয়ে নিয়ে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করেছেন তিনি। তার এলাকার একজন সফল খামারির পরামর্শ নিয়ে ৫০০টি হাঁসের বাচ্চা ক্রয় করেন। এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন রোগের কারণে কিছু সংখক হাঁস মারা গেলেও তার প্রায় সাড়ে ৩শ’ হাঁস ডিম দেয়া শুরু করে। বাড়ির পাশেই বিশাল মাঠ থাকার কারণে বাড়তি খাবার দিতে হয়নি। মাঠের মধ্যে থাকা ছোট ছোট মাছ, শামুক খেয়েই থাকে। হাঁসের ডিম বিক্রি করে নিজের সংসার খুব ভাল ভাবেই চলছে। সংসারের খরচের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ করেও সে অনেক টাকা আয় করতে পারছেন।

তিনি আরও বলেন, গ্রামের মাঠে অল্প পানিতে উন্মুক্তভাবে হাঁস পালন করা যায়। কারণ হাঁস বেঁধে রেখে পালন করা ব্যয়বহুল। এ কারণে উন্মুক্তভাবে পালন করতে হয় তাদের।

কৃষি নির্ভর দেশে বেকার যুবকদের হাঁস পালনের পরামর্শ দিয়ে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, মাসুদ ও মরিয়মের মতো যদি বেকার নারী-পুরুষেরা চাকুরীর পিছনে না ছুটে অল্প পুঁজি নিয়ে যদি হাঁসের খামার পালন শুরু করেন তাহলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা দূর হবে অন্যদিকে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে দেশ লাভবান হবেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো: আখতারুজ্জামান ভুঁইয়া জানান, জেলায় ২৩৬ টি হাঁস পালনের খামার রয়েছে। ভাসমান পদ্ধতিতে হাঁস পালনে খরচ অনেকটাই কম হয়। লাভ তুলনামূলক অনেক বেশি। খামারীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা না করতে পারলেও হাঁসের চিকিৎসা, টিকা ও পরামর্শ দিয়া হয়।