পদ-মনোনয়ন বাণিজ্যে টালমাটাল বিএনপি

তারেকের নেতৃত্বে আস্থা নেই নেতাদের, নয়াপল্টন-গুলশান অফিসের সমন্বয় নেই, দলের ভেতর চেইন অব কমান্ডের বালাই নেই, নেতাদের বক্তব্যে নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি, ঘুরে দাঁড়ানোর রোডম্যাপ ছাড়াই চলছে দল। পদ আর মনোনায়ন বাণিজ্যের জেরে প্রকাশ্যে এসেছে দ্বন্দ্ব। পারস্পরিক অবিশ্বাসে বিভক্তির দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি।

মূলত দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফেরায় অনিশ্চিয়তাই দলটিতে বিভক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব মানতে পারছেন না বেশির ভাগ নেতা। সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম হিসেবে স্থায়ী কমিটি থাকলেও কমিটির সদস্য নেতাদের মতামতের গুরুত্ব নেই দলে। লোকদেখানো বৈঠকে সবাই থাকেন চুপ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বেশির ভাগ ভুল সিদ্ধান্তের দায় এসে পড়ছে দলের মহাসিচব মির্জা ফখরুলের ঘাড়ে।

মির্জা ফখরুলের বাসভবন গত ১০ অক্টোবর রবিবার ঘেরাও করে ঢাকা উত্তরের তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা। সেখানে তারা ফখরুলের বাসায় ইটপাটকেল ও পচা ডিমও নিক্ষেপ করে। এ সময় মির্জা ফখরুল বাসায় থাকায় বিব্রত হন। জানা গেছে, ঢাকা ১৮ আসনে উপনির্বাচনে তারেকের মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। পরে স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

জানা গেছে, ঢাকা উত্তরের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন ৯ জন। এর মধ্যে দুজন আলোচিত ছিলেন। সবচেয়ে আলোচিত ও শক্ত অবস্থানে ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর যুবদলের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীরকে। যিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং তার এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা নেই। মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের বিনিময়ে এই মনোনয়ন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

সূত্র জানায়, কফিল উদ্দিন আহমেদকে মনোনয়ন দিতে টেলিফোনে তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন তারেক। কিন্তু টাকা দিতে সরাসরি অস্বীকার না করলেও তার কাছে এই মুহূর্তে এই পরিমাণ টাকা নেই বলে জানান কফিল। এরপরই লন্ডন ঘুরে আসেন জাহাঙ্গীর। তারেকের সঙ্গে দেখা করে তিন কোটি টাকা দিয়ে আসেন বলে কথিত রয়েছে। তারেক রহমানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সাম্প্রতিক কিছু ছবিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

তবে দলের মধ্যে বিভাজন বা আস্থার সংকট, কোনোটাই মানতে নারাজ বিএনপির বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, বিভক্তির চক্রান্ত চলছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেই ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকে। তিনি বলেন, নির্বাচনের পরই দল গোছানোর কাজ চলছে। সাংগঠনিক এ কার্যক্রম শেষে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

সম্প্রতি দলের ভেতরে নেতাদের স্ববিরোধী বক্তব্যও বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রকাশ পাচ্ছে বিদ্রোহের আভাস। তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্বপালন করলেও স্থায়ীভাবে এই দায়িত্বে তাকে দেখতে চান না অনেক সিনিয়র নেতা। এ নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির তিন জন ভাইস চেয়ারম্যান নানামুখী প্রশ্ন তুলেছেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর বেসরকারী টেলিভিশন ‘টকশো’তে কথা বলতে গিয়ে দলের শীর্ষ দুই নেতাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগার থেকে আপস করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি নিয়েছেন এবং তার উত্তরসূরি হিসেবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে বলে মন্তব্য করেন তারা। নেতারা বলছেন, নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই আপসের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন খালেদা জিয়া। আর এ কারণেই তিনি আপস করে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তারেক রহমানকে খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি মনোনীত করা ভুল সিদ্ধান্ত। খালেদা জিয়া না থাকলে রাজনীতি ছাড়ার কথা ভাবছেন তারা। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন তার একটিই কারণ তিনি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী। অথচ সেই জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার করলেন না কেন?

আর মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে আপস করে ফেলেছি। এ কারণে খালেদা জিয়া জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। খালেদা জিয়াই বিএনপির বর্তমান ও ভবিষ্যতের একমাত্র নেতা। তারপরে কে জানি না। শাহজাহান ওমর বলেন, লন্ডনে বসে কথাবার্তা-ভাব আদানপ্রদান করা কঠিন।

জানতে চাইলে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, আমি অন্যায় কিছু বলিনি। আমি বলেছি বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এখন যারা আছেন তাদের বয়স হয়েছে, অনেকেই অসুস্থ। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। তাই স্থায়ী কমিটিতে যে শূন্য পদগুলো রয়েছে সেখানে যোগ্য ও তরুণ নেতৃত্ব বসিয়ে নতুন পরিকল্পনায় দল পরিচালনা করলে ভালো হবে। তিনি বলেন, তারেককে নেতা মানার প্রশ্নই ওঠে না। আমি কারো দয়ায় রাজনীতি করি না।

সূত্র জানায়, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নির্দেশ পাশ কাটিয়ে বিশেষ ক্ষমতা বলে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ নিজের মতো দলের কাজ পরিচালনা করছেন। গুঞ্জন রয়েছে, কাগজে কলমে ফখরুল মহাসচিব হলেও দলের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা ও সিদ্ধান্তে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেখান রিজভী । সারাদেশের বিএনপির রাজনীতিকে এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। মহাসচিব হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থেকেই বর্তমান মহাসচিবকে নিষ্ক্রিয় প্রমাণ করতে অনেক কাজ নিজ দায়িত্বেও করেন তিনি। তবে ধীরবুদ্ধিসম্পন্ন মির্জা ফখরুল বিষয়গুলো বুঝতে পেরে চেপে গেলেও মাঝে-মধ্যেই এ নিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নয়াপল্টন অফিসে নিয়ম করে ভিডিও কনফারেন্সে রিজভী আহমেদের সঙ্গে বৈঠক হয় তারেক রহমানের। দলের ভেতরের নানা তথ্য আদানপ্রদান হয় ওই বৈঠকে। ফাঁক বুঝে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে সিনিয়র নেতাদের নামে বিষোদগার করতেও ভুল হয় না তার। কোনো নেতা সরকারের সঙ্গে লবিং করে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রেখে রাজার হালে চলছেন। কার দলের কাজে মন নেই এসব বিষয়ে তথ্য পৌঁছে দেন তিনি। পরে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতাদের উপরে রিজভীর বক্তব্যের জের টানেন তারেক।

এমনকি রিজভী আহমেদের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ করছেন। যেখানে টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিতে অনভিজ্ঞদের বড় পদে বসানো হচ্ছে। ফলে যোগ্য, মেধাবী ও চৌকস নেতার অভাবে অঙ্গসংগঠন প্রায় অকেজো। গত ২২ জুন দলীয় গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক বিধিনিষেধ এবং মানবিক দিক অমান্য করে ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদকের শূন্যপদে উত্তরের সহসভাপতি আবদুল আলিকে বসান রিজভী আহমেদ।

অথচ তার এই সিদ্ধান্তের কথা জানতেন না মির্জা ফখরুলসহ সিনিয়র নেতারা। শুধু তাই নয়, পরের দিন সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। রিজভীর এসব কর্মকাণ্ডে দলের চেইন অব কমাণ্ড ভেঙে পড়লেও এ নিয়ে মুখ খুলতে চান না সিনিয়র নেতারা।

১২ অক্টোবার, ২০২০ at ১২:২৪:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভক/এমএআর