সাহায্য পাওয়ার জন্য নয়, বলছি সতর্ক করার জন্য: শেখ হাসিনা

সারাবিশ্ব এখন করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কাছে পর্যুদস্ত। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের মোকাবিলায় লড়ছে গোটা বিশ্বের মানুষ। একইসঙ্গে জলবায়ু সঙ্কটও কেড়ে নিচ্ছে বহু মানুষের আশ্রয়স্থল। এই দুই সংকট মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ বর্তমানে বৈশ্বিক হুমকি। এই উভয় ঝুঁকি প্রশমনে আমাদেরকে আরো অনেক কিছু করতে হবে। আর তা করতে হবে ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে।

ক্লাইমেট ভারনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যের নেতৃস্থানীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে একথা বলেন। নিবন্ধটি মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়েছে।

‘আ থার্ড অফ মাই কান্ট্রি ওয়াজ জাস্ট আন্ডারওয়াটার। দ্য ওয়ার্ল্ড মাস্ট অ্যাক্ট অন ক্লাইমেট’ শিরোনামে ওই নিবন্ধে তিনি আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদে থাকা দেশগুলোকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সত্যি হলে তারাও বেশিদিন নিরাপদে থাকতে পারবে না।

নিবন্ধে তিনি বলেন, গতমাসেও আমার দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি এতে বাস্তুচ্যুত হয়। লাখ লাখ হেক্টর জমির ধান বন্যার পানিতে ভেসে যায়। ফলে লাখ লাখ মানুষের জন্য এ বছর খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন হবে।

দুর্যোগ কখনো এককভাবে আঘাত হানে না। গত মে মাসে বন্যার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়। এর পাশাপাশি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঝুঁকিতে থাকা এলাকা থেকে ২৪ লাখ মানুষকে আমাদের সরিয়ে নিতে হয়েছে, আর তা করতে হয়েছে তাদের কোভিড-১৯ এর আরও বড় ঝুঁকিতে না ফেলে। আপাতত সংক্রমণ আর মৃত্যু হার সীমিত রাখা সম্ভব হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত এ রোগ থেকে কার্যকর সুরক্ষার একটি উপায় পাওয়া না যাচ্ছে, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখায় আমাদের তৈরি পোশাক খাত এবং রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। হাজার হাজার প্রবাসী কর্মীকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। তাদের একটি বড় অংশ এখনও বেকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা অন্য সব দেশের মত বাংলাদেশকেও এখন লড়তে হচ্ছে জীবন বাঁচানোর জন্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে হচ্ছে, আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে কোটি কোটি মানুষকে সাহায্য করতে হচ্ছে। আর এর সবকিছুর সঙ্গে এটাও দেখতে হচ্ছে, অর্থনীতি যেন ধসে না পড়ে।

নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি সাহায্য পাওয়ার জন্য এসব বলছি না; বলছি সতর্ক করার জন্য। অনেক দেশ হয়ত জলবায়ু সঙ্কটে এতটা ঝুঁকির মধ্যে নেই। কিন্তু বেশিদিন এই বিধ্বংসী শক্তিকে এড়ানো তাদের পক্ষেও সম্ভব হবে না। আমাদের চেয়ে যারা ভাগ্যবান, সেসব দেশের খুব ভালো করে দেখা উচিৎ, কীসের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এভাবে বাড়তে থাকলে এই শতকের মাঝামাঝি সময়েই পৃথিবীর নিচু এলাকাগুলোর শত কোটি মানুষকে বাস্তুহারা হতে হবে।

তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন আর কোভিড-১৯ আজকের বিশ্বের জন্য বড় হুমকি। এসব ঝুঁকি কমিয়ে আনার জন্য আমাদের আরও বেশি উদ্যোগী হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু বিপদ যখন ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, তখন আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে এর মোকাবিলা করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

জলবায়ু সঙ্কট আর মহামারি, দুটোই জটিল সমস্যা, এগুলোর প্রভাব বহুমুখী। সবাই মিলে এর সমাধান করতে হবে, না হলে কোনো সমাধানই হবে না। কোনো একটি দেশ যদি শুধু নিজেদের জন্য করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারও খরচ করে, তাতে সুফল আসবে না যদি অন্য দেশে মহামারি বেড়ে যায়। ঠিক একইভাবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কার্বন গ্যাস নিঃসরণের লাগাম টেনে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি গড়ে তুললেও তাতে কাজ হবে না, যদি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলো একই পথ অনুসরণ না করে।

প্রধানমন্ত্রী নিবন্ধে বলেছেন, বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন গ্যাস নিঃসরণ হয়, তার ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী জি টোয়েন্টি (শিল্পোন্নত) দেশগুলো। আর তালিকার নিচের ১০০ দেশ সব মিলিয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ নিঃসরণের জন্য দায়ী। জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় পৃথিবী সফল হতে পারবে না যদি প্রত্যেকে সচেষ্ট না হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলো কমিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে থাকা সবচেয়ে ভালো সুযোগ হলো ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাস্তবায়ন। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৯টি দেশ ওই চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না হতে পারে সেজন্য ওই চুক্তিতে নিঃসরণের মাত্রা সম্মিলিতভাবে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়েছে। আর সম্ভব হলে এর মাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চেষ্টা করার কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় ওই লক্ষ্যের প্রস্তাব করা হয়েছিল ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) পক্ষ থেকে। বর্তমানে আমি সিভিএফের প্রধান। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অন্যায়ভাবে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে-এমন ৪৮টি দেশ এই ফোরামের সদস্য, বাংলাদেশ তার একটি। জলবায়ু ঝুঁকি প্রশমন ও অভিযোজনের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে সিভিএফ দেশগুলোই সামনের কাতারে রয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলো, যারা জলবায়ু সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে, তারা আমাদের পাশে আছে। ২০২০ সালের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, আফ্রিকার ৪৩টি দেশ এবং এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার আরও বহু দেশ জলবায়ু সঙ্কটে প্রতিশ্রুত লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়েছে, যা বিশ্বের ধনী দেশগুলো পারেনি।

জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক যে তহবিল এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তাছাড়া নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর করা যাবে না যদি বড় দেশগুলো এর নেতৃত্বে এগিয়ে না আসে।

আমরা যদি আমাদের প্রত্যাশাগুলো প্রসারিত না করি, আমাদের সবাইকে হারতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং জলবায়ু ঝুঁকি কমিয়ে আনার কাজে যত বেশি দেশ আর কোম্পানিকে যুক্ত করা যাবে, অর্থনীতিকে তত বেশি অভিযোজনক্ষম, টেকসই ও প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হবে।

জলবায়ু সঙ্কট, কোভিড-১৯ আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে, সহযোগিতার গুরুত্বের কথা বলছে। আজ এই সময়ে পুরো বিশ্বের বিপরীতে চলা কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব না।

জাতিসংঘের আগামী জলবায়ু সম্মেলনে প্রত্যেকটি দেশকে তাদের নিজ নিজ ভূমিকা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। আর এতে যেসব সমস্যা আমাদের সবার অস্তিত্বকে ঝুঁকিতে ফেলছে সেসব সমস্যা মোকাবিলা করার আশা পাব।

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ১৩:৫৭:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সক/এমএআর