তাকসিমই হচ্ছেন ওয়াসার টানা ষষ্ঠ মেয়াদের এমডি

টানা পাঁচ মেয়াদে ১১ বছর দায়িত্ব পালনের পর ষষ্ঠ মেয়াদেও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে তাকসিম এ খানকে নিয়োগের প্রস্তাব করেছে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড। শনিবার বিকেলে অনলাইনে অনুষ্ঠিত বোর্ড মিটিংয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বোর্ডের এই সিদ্ধান্তটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে সেখানেই।

তাকসিম এ খান ২০০৯ সালের অক্টোবরে প্রথম দফায় ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। ওই নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। তারপরও চারবার নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। প্রতিবারই নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আগামী ১৪ অক্টোবর তার পঞ্চম দফার মেয়াদ শেষ হবে। এবার চূড়ান্ত নিয়োগ পেলে ষষ্ঠ মেয়াদে ঢাকা ওয়াসার এমডির দায়িত্ব পাবেন তিনি।

শনিবারের সভায় বোর্ডের ৯ সদস্যের মধ্যে তিনজন তাকসিম এ খানের পুনর্নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দেন। তারা ওয়াসায় সংঘটিত নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আগে তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগের জন্য নিয়ম অনুসরণ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আবেদনপত্র আহ্বান করতে বলেন।

তবে তাকসিম এ খানের মেয়াদ বৃদ্ধির পক্ষে মতদানকারীরা বলেন, ওয়াসার এমডির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবই ছিল একমাত্র এজেন্ডা। কাজেই কোনো বিকল্প নেই।

বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠকে বেশ হট্টগোলও হয়। বৈঠকে নয়জন সদস্য ছাড়াও ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান যুক্ত ছিলেন। এ নিয়ে একজন সদস্য আপত্তি করেন। শেষ পর্যন্ত তাকসিম এ খান বৈঠকে যুক্ত থাকেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, বিকেল সোয়া ৫টার দিকে সাবেক এমপি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে বৈঠক শুরু হয়। শুরুতেই বোর্ড সদস্য প্রকৌশলী ওয়ালীউল্লাহ শিকদার আলোচ্যসূচি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের আলোচ্যসূচি দিয়ে বৈঠক ডাকা হলো কেন?’ জবাবে সভাপতি কিছুটা নীরব থাকেন।

আরেক সদস্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক বলেন, বোর্ড সভাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাকসিম এ খানের মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে। কাজেই নিয়ম অনুযায়ী তিনি মিটিংয়ে যুক্ত থাকতে পারেন না।

মানিক বলেন, যেহেতু বিভিন্ন সময় ওয়াসার নানা কার্যক্রম ও ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে; এ কারণে আবারও তিন বছরের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য তার নাম প্রস্তাব করা বিব্রতকর। বরং পত্রিকায় এমডি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাকসিম এ খান আবারও আবেদন করে এমডি হলে আপত্তি নেই। কিন্তু এ অবস্থায় তাকসিম এ খানের মেয়াদ বৃদ্ধির পক্ষে তিনি মত দিতে পারেন না।

বোর্ড সদস্য ওয়ালীউল্লাহ শিকদার বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ সরকার করোনায় মারা গেছেন। তার শোকের রেষ কাটতে না কাটতেই কেন এই সভা ডাকা হলো? আর তাতে এই আলোচ্যসূচি কেন অন্তর্ভুক্ত করা হলো?

ওয়ালীউল্লাহ শিকদার আরও বলেন, ‘বৈঠকে আমি বলেছি, ওয়াসায় যত দুর্নীতি-অনিয়ম গত ১১ বছরে হয়েছে; বোর্ডের উদ্যোগে আগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে বুয়েটের অধ্যাপকদের দিয়ে তদন্ত করা যেতে পারে। এটা না করে তাকসিম এ খানের নাম কোনোভাবেই এমডি হিসেবে প্রস্তাব করা যাবে না।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ও ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সদস্য শাবান মাহমুদ বলেন, ‘বোর্ডের ৯ সদস্যের মধ্যে মূলত একজন তাকসিম এ খানের বেশি বিরোধিতা করেছেন। সভাপতিসহ ছয়জন মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে দৃঢ় মত দিয়েছেন। আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ওয়াসার গত ১০ বছরের কার্যক্রমে বিভিন্ন সময় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ঢাকা শহরে এখন পানির কোনো সংকট নেই। ঢাকা ওয়াসার আরও অনেক সফলতা আছে। এ জন্য বেশিরভাগ সদস্য তার মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী যেহেতু চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন, তিনি যার প্রশংসা করেছেন, আমরাও তাকেই সমর্থন করেছি। আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।’

বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সেলিমা রহমান, ডিএসসিসির কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক ও ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রতিনিধি প্রকৌশলী ওয়ালী উল্লাহ শিকদার এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন।

অন্য সদস্য সাংবাদিক শাবান মাহমুদ, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হামিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টসের প্রতিনিধি কামরুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আলেয়া সারোয়ার ডেইজি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদ হোসেন মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে সম্মতি দেন। পরে বৈঠকের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রস্তাবটি দ্রুত মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন।

এর আগে গত ২৬ আগস্ট ওয়াসা বোর্ডের সভায় তাকসিম এ খানের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়। তখন কয়েকজন সদস্য এর বিরোধিতা করেন। তখন বলা হয়, পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হবে। পরে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওয়াসা বোর্ডের সচিব শারমিন হক আমীর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় অনলাইনে বিশেষ বোর্ড সভা হবে। একমাত্র আলোচ্য সূচি রাখা হয়, তাকসিম এ খানকে তিন বছরের জন্য নিয়োগের প্রস্তাব স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণ।

১৯৯৬ সালে পাস হওয়া ওয়াসা অ্যাক্ট অনুযায়ী সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন এমডি। নিয়ম অনুযায়ী, ওয়াসা বোর্ড গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে আবেদনপত্র আহ্বান করবে। আবেদনকারীদের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাইকৃত তিন থেকে পাঁচজন যোগ্য প্রার্থীর তালিকা মেধাক্রম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে বোর্ড। মন্ত্রণালয় আরও যাচাই-বাছাই করে একজনকে নিয়োগ দিতে পারবে। মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হলে বা মনে করলে আরও যাচাই-বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাবে। প্রধানমন্ত্রী তাদের মধ্য থেকে একজনকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করবেন।

ষষ্ঠবারের মতো তাকসিম এ খানের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, ঢাকা ওয়াসা পানির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সফলতা দেখালেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওয়াসার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ জন্য এবার এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিল।

তাকসিম এ খানকে পুনর্নিয়োগের প্রস্তাবের সমালোচনা করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেছেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বকালে জনদুর্ভোগের বিষয়টি কারও অজানা নয়। টিআইবির গবেষণা ও নির্ভরযোগ্য সংশ্নিষ্ট সব সূত্রে ওয়াসার ছোটবড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সেবা পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভূতপূর্ব বিস্তারের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবং তার কোনো কোনো বিষয় তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, সরকারপ্রধান যেখানে বারংবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার কথা বলছেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তখন এর একটা সুরাহা হবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ওয়াসায় শুদ্ধাচার বা সুশাসনের সম্ভাবনার কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছি।’

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ২২:৫৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেরু/এমএআর