‘কর্মহীন’ হয়ে পড়েছে ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলো

দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো ‘কর্মহীন’ হয়ে পড়েছে। তাদের নেই কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক কার্যক্রম। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীতে চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। যাও দেখা গেছে তাও নামকাওয়াস্তে। এক কথা বলতে গেলে ‘কর্মহীন’ হয়ে আছে ধর্মভিক্তিক দলগুলো। খবর মানবকন্ঠ

আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির জোটের অংশ হয়েও তাদের কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক কার্যক্রম চোখেই পড়ছে না। একবারেই নীরব, নিশ্চুপ তারা। আপামর জনগণের পাশে নেই তারা।

ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘করোনকালে আমরা সেবা করছি মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে। জানাজার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছি। আর্থিক ও খাবার পৌঁছে দিয়েছি।’

হেফাজত ইসলামী এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কিভাবে হয়েছিল অতীতে সবাই জানে। বর্তমান অবস্থাটাও জানা। এ বিষয়ে আমি কথা বলব না।’ তবে তাদের দাবি করোনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও সাধারণ মানুষের পাশে সক্রিয় রয়েছেন তারা। বন্যা, দুর্যোগ, করোনায় মৃতদের দাফন এবং ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করছেন তারা। তারা বলছেন, ‘লকডাউনে রাজনীতি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে বিবৃতির মাধ্যমে পত্রিকায় সরব থাকার চেষ্টা ছিল।’

জানা গেছে, খেলাফত মজলিশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ছাড়া সব ধর্মভিত্তিক দল এখন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অনুসারী। ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মেনে নেয় সরকার। এরপরেই সব ধর্মভিত্তিক দল এখন সরকারের আষ্টেপৃষ্ঠে আছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। জাতীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুতে হেফাজত ইসলামসহ এসব দলের প্রকাশ্য তৎপরতা বর্তমানে নেই বললেই চলে। তবে করোনা ভাইরাসের আগে মিডিয়ায় প্রায়ই ঘরোয়া পরিবেশের সভা-সমাবেশের খবরা-খবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে সক্রিয় থাকার কথা স্বীকার করেছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। এর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলগুলোর নেতারা কিছুটা সক্রিয় হলেও নির্বাচনের পরে নিশ্চুপ হয়ে যায়।

নির্বাচন কমিশনে এখন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০টি। এর মধ্যে ইসলামি বা ইসলামপন্থি দল ১০টি। দলগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন (নজিবুল বশর), খেলাফত মজলিস (ইসহাক), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (ইসমাইল), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউর রহমান), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), জাকের পার্টি (মোস্তফা আমীর) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (মোমেন)।

দলের দায়িত্বশীলরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ও করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সময় মোবাইলফোনে নেতাকর্মীদের স্বাস্থ্য সচেতন ও জনগণের পাশে থাকার পাশাপাশি সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন নেতাকর্মীদের। এমনটি জানিয়েছে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এমএ আউয়াল।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে মানবসেবা, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে করা যায়। যা দেখা যায় না। যেমন এখন করোনা মহামারী চলছে। এ পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কোথাও ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরি হয়নি। যার কারণে ধর্মীয় দলগুলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে মানবজাতির কল্যাণে জন্য, মুক্তির জন্য, আল্লাহর দরবারে দোয়া করছেন।

ইসলামী ঐক্যজোট: মুফতি আমিনীর সময় ইসলামী ঐক্যজোট রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত থাকলেও তার মৃত্যুর পর দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে ধীরগতি। ২০ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্রভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাসনাত আমিনী ও মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের সময় দলটির চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। দলটির মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহর দাবি মহামারী দুর্যোগের সময় ব্যাপক কাজ কররেছে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকর্মীরা।

তিনি বলেন, আসলে এখন হলো মানবতার কল্যাণে মানুষ বাঁচানোর সময়, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানো এটাই হচ্ছে বড় রাজনীতি। আমি মনে করি প্রত্যেক রাজনীতি দল মানুষের পাশে রয়েছে। অতএব রাজনীতি চলমান।

ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি: দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হচ্ছেন- এম এ আউয়াল। তিনি আগে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব ছিলেন। বর্তমানে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির মাধ্যমে সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে।

ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ: একাদশ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে যুক্ত হবার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। বর্তমানে দলটির অবস্থান আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে। তবে করোনা ভাইরাসে সারাদেশে জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলেও জনগণের পাশে ছিলেন বলে জানান দলটির চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ।

তিনি বলেন, ‘আমার দল জনগণের দল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ইসলামিক ঘরানার। আমাদের সংগঠনের একটি সহযোগী সংগঠন আছে। তার নাম হচ্ছে খোদ্দামুল মুসলিমীন। যেটা মানবসেবার কল্যাণে নিয়োজিত থাকে। এবার করোনাকালীনসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষকে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। অক্সিজেন সরবরাবহ করেছে। ফ্রি অ্যাম্বেলেন্স সার্ভিস দিয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ: সংগঠন শক্তিশালীকরণে জোর দিচ্ছেন চরমোনাই পীর। প্রধান দুই জোটের বাইরে ধর্মীয় অন্যতম শক্তিশালী দল মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচনের দিন বর্জন করে। বর্তমানে চরমোনাই পীর ও তার দলের নেতাকর্মীরা বর্তমান সংসদ ভেঙে প্রতিনিয়ত নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।

করোনা ভাইরাসের সময় সংগঠনের ভূমিক সম্পর্কে দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমেদ বলেন, করোনা ভাইরাসে আমাদের ভ‚মিকা ছিল বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়।

তরিকত ফেডারেশন: সংগঠনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল সংগঠন ত্যাগ করার পর দলটির সাংগঠনিক কাঠোমো ভেঙে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। করোনা সময় তরিকত ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। কোথাও সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। এ প্রসঙ্গে দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারি বলেন, ৪০টি জেলায় জনগণের পাশে ছিলাম।

খেলাফত মজলিস: মাওলানা ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস ২০ দলীয় জোটের শরিক দল। করোনাকালে দলটির কার্যকম থাকলেও সাংগঠনিক কার্যক্রম চোখে পড়েনি। রাজপথের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম: ২০ দলীয় জোটের আরেক শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দল গোছাতে ব্যস্ত। করোনাকালে মানুষের পাশে না থাকলেও সাংগঠনিক কর্ম তৎপরতা চলছে বলে জানিয়েছে দলটির এক শীর্ষ নেতা।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট: দলটির চেয়ারম্যান এম এ মান্নান ও মহাসচিব এম এ মতিনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে। অবশ্য একাদশ নির্বাচনের আগে এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোটে’ অংশ নেয়। পরবর্তীতে জোট ত্যাগ করে এখন স্বতন্ত্র অবস্থানে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এমনটি জানিয়েছে দলের মহাসচিব এম এ মতিন।

খেলাফত মজলিশ: দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললে চলে। তবে করোনাকালীন সক্রিয় না থাকলে সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন দাবি করে মহাসচিব মাহফুজুল হক বলেন, সাধ্যনুযায়ী সহায়তা করছি। সারাদেশে বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।

০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ১২:১৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মাক/এমএআর