ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ‘করোনা রোগী’ শনাক্ত করলেন কাস্টমস কমিশনার!

ভারত থেকে আসা অসুস্থ এক বাংলাদেশিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ‘করোনা রোগী’ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন-নিজ ফেসবুক পেজে এমন স্ট্যাটাস দেন বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী। এমনকি ওই তরুণের পাসপোর্ট ও ছবিসহ পুরো পরিচয়ও তুলে দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।

তবে চিকিৎসকরা তাকে ‘করোনা রোগী’ হিসেবে শনাক্ত না করায় সেই পোস্ট মুছে (ডিলিট) দিয়ে আবারও আরেকটি পোস্টে লেখেন ‘শনাক্ত নয়’। সেখানেও সচেতনভাবে ভারত থেকে আসা ওই তরুণের নাম, পিতার নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং ছবি পোস্ট করেছেন বেলাল চৌধুরী।

‘করোনাভাইরাস’ নিয়ে কোনো ধরনের গুজব ছড়ানোসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ছবি কিংবা পরিচয় প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ থাকলেও একটি দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে এ ধরনের পোস্ট কীভাবে দেয়া হলো— এ বিষয়ে কাস্টমম কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরীর বক্তব্য, ‘ওটা তো ডিলিট করে দিয়েছি। মূল পোস্ট ডিলিট হয়ে গেছে। মূলত সচেতনতা বাড়াতে এমন পোস্ট দেয়া।’
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস কেড়ে নিল আরও ১০৮ প্রাণ

বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সোয়া বারোটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে—‘করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে যারা হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য ভর্তি হচ্ছেন এবং তাদেরকে শনাক্ত করা যায়—এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না।’ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, ‘প্রচার-প্রচারণার কারণে কেউ যেন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন না হয়, সেদিকে অবশ্যই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’

বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া বারোটায় বেলাল চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘বেনাপোলে ভারত থেকে আসা করোনা রোগী শনাক্ত।’

‘ভারত থেকে আসা বন্ধন এক্সপ্রেস থেকে একজন করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা রেলের নিয়মিত দায়িত্ব পালনকালে একজন বিশ্বস্ত সূত্রে গোপনে সংবাদ পায় এবং রোগীকে শনাক্ত করেন। তাৎক্ষণিক এসি উত্তম চাকমা ও আকরাম হোসেন বিষয়টি যশোর সিভিল সার্জন অফিস ও উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসকে জানান এবং সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে আনেন।’

এরপর তিনি ‘শনাক্ত’ হওয়া রোগীর নাম, তার পিতার নাম এবং বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করেন।

এরপর বেলাল চৌধুরী লিখেছেন, ‘তিনি (ওই তরুণ) চীন থেকে ভারতে আসেন। ভারতীয়রা বিষয়টি সম্ভবত বুঝতে পেরে তাকে টিকিট ছাড়াই ট্রেনে তুলে দেয়। তিনিও আত্মগোপন করেছিলেন। কাস্টমস টিম চিকিৎসকদের আসা নিশ্চিত করে। বর্তমানে তিনি (তরুণ) সিভিল সার্জন টিমের হেফাজতে আছেন।’
আরও পড়ুন: করোনা: আইসিইউতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশি

কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরী পরের প্যারায় করোনা ভাইরাস নিয়ে বেনাপোল কাস্টমস অফিসের সচেতনতার কথা লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘বিস্ময়কর হলেও বেনাপোল কাস্টম হাউজে কর্মকর্তাদের তৎপরতায় এ অঞ্চলে প্রথম করোনা রোগী দেশে ঢোকার আগেই ধরা পড়ে। যে কেউ এমন রোগী দেখলে চিকিৎসক টিমকে জানান। রোগী যথার্থ পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, ভাইরাস ছড়িয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগে। অবহেলায় উল্টোটা ঘটে।’

বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তিনি ওই তরুণের ছবি, নাম-পরিচয়, পিতার নাম, পাসপোর্টের ছবি পোস্ট দেন তার পেজে। মুহূর্তের মধ্যে তা ভাইরাল হয়ে যায়।

তবে এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর তিনি ওই তরুণের ছবি ও নামসহ আবারও একটি পোস্ট দেন। এবার লেখেন, ‘চিকিৎসকের পরীক্ষায় ওই তরুণকে করোনা ভাইরাসমুক্ত বলা হয়েছে। আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।’

তিনি লেখেন, ‘ভারতের রেলগার্ড মেন্যুফেস্টো দিতে গিয়ে বেনাপোল কাস্টমস টিমের রাজস্ব কর্মকর্তাকে বলেন ‘ট্রেনে ৬৫ জন যাত্রী, একজন অনুপস্থিত ও একজন করোনা রোগী আছে! তাৎক্ষণিক চেকপোস্টের ডাক্তার আজিমউদ্দিন আসেন এবং তার পাসপোর্ট দেখে তাকে সম্ভাব্য রোগী হিসেবে আলাদা করে নেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করেন।’

‘‘গার্ডের বক্তব্য, ডাক্তারের করোনা সন্দেহজনক যাত্রী খুঁজে পাওয়া ও যাত্রীর ভাবভঙ্গি থেকে তাকে আমাদের টিম সন্দেহবশত ‘করোনা রোগী’ বলেছে। এ বিষয়ে কোনও সংশয় তৈরি হলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত!’’

‘কাস্টমস চেকপোস্টে সচেতনতার জন্য আমরা গত ২৯ জানুয়ারি তারিখে করোনা সচেতনতা সেমিনার করি। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রদর্শিত নির্দেশনালোকে কাস্টমস টিম দায়িত্বের অংশ হিসেবে রোগী আলাদা করে স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে হস্তান্তর করে।’

‘আমরা সচেতনতার জন্য পোস্ট দেই। সংশয়ের জন্য নয়। দয়া করে কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না।’ এই ছিল বেলাল চৌধুরীর দ্বিতীয় পোস্টের বক্তব্য।
আরও পড়ুন: ৪০ বছর আগে প্রকাশিত উপন‌্যাসে ইঙ্গিত করোনাভাইরাসের!

এদিকে ভারত থেকে বেনাপোলে আসা তরুণকে করোনা সন্দেহে পরীক্ষা করে কোনও আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন। তিনি বলেন, ‘উনাকে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। তাকে তার বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়েছে এবং ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে যদি তার শারীরিক অসুস্থতা পরিলক্ষিত হয়, তবে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সন্দেহভাজন এই যাত্রীর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।’

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানো প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে একশ্রেণির মানুষ গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে। মুরগির মাংস খাওয়া, মাস্ক ব্যবহার করা থেকে শুরু করে বিদেশফেরত সুস্থ মানুষকে নিয়েও গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআর বলছে, গুজব ছড়ালে এ ভাইরাস মোকাবিলায় বাধা সৃষ্টি করবে।

দেশদর্পণ/এসজে