এক ফসলি জমিতে তিনটি ফসল আবাদে অতিরিক্ত উৎপাদনের সাফল্য

নওগাঁ জেলার সদর উপজেলাসহ আওতাধীন মান্দা, রাণীনগর, আত্রাই, পত্নীতলা এবং ধামুইরহাট উপজেলার বিল ও বিল সংলগ্ন এলাকায় বছরের বেশির ভাগ সময়ই জলাবদ্ধতা থাকতো। এতে করে শুধুমাত্র বোরো ফসল উৎপাদন হতো। সে কারণে বিল ও বিল সংলগ্ন এলাকার খাস খাল/খাড়ীসমূহ পুন:খননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ করে আমন/আউশ, ইরি/বোরো ও রবি শস্যসহ প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।

এরই অংশ হিসেবে নওগাঁ জেলায় ‘ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হয়। এটি ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত চার বছর মেয়াদে ৯২ দশমিক ২০ কিলোমিটার খাল পুন:খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

আরও পড়ুন:
পাম্প শ্রমিকরা ডিজেল দেননি এমপি’র গাড়িতেও
অটিজম শিশুরা সমাজের বোঝা নয়: শিক্ষামন্ত্রী

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও ভূ-উপরিস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার হেক্টর এক ফসলি জমিতে বছরে তিনটি ফসল (আউশ/আমন, ইরি/বোরো ও রবি শস্য) আবাদ করা হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত প্রায় ৫২ হাজার মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমান বাজার দর হিসেবে যার আনুমানিক মূল্য ১০৫ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি অর্জিত হলে প্রকল্প এলাকায় ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টরের অধিক জমিতে চাষাবাদ করে আরো অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, প্রকল্প এলাকায় আবাদের আওতায় এসেছে ১৬ হাজার হেক্টরের বেশি পতিত আবাদি জমি। বেড়েছে ধান উৎপাদন। প্রত্যক্ষভাবে সুফল ভোগ করছেন নওগাঁর ৬টি উপজেলার দেড় লাখের (এক লাখ ৬০ হাজার) বেশি কৃষক। সরেজমিনে প্রকল্প এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিএমডিএ’র উদ্যোগে এই খাল খনন প্রকল্পই তাদের মনে আশার সঞ্চার করেছে। আগে তারা কৃষি ফসল উৎপাদনে কোনো সুফলই পাননি। আর যখনই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, তারপর থেকেই কৃষি ফসল উৎপাদনে তারা সাফল্য দেখতে থাকেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের আওতায় নওগাঁ সদর, মান্দা, রাণীনগর, আত্রাই, পত্নীতলা ও ধামুইরহাট উপজেলার ওপর দিয়ে প্রায় ৯৩ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজ ও ক্রস ড্যাম রয়েছে ১৩টি। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৭৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। প্রকল্প এলাকার খননকৃত খাল ও জলাশয়ের পাড়ে ৩০ হাজার বৃক্ষরোপন করা হয়েছে। এরমধ্যে এক হাজার ফলদ এবং ২৯ হাজার বনজ চারা রোপন করা হয়। বর্তমানে রোপনকৃত গাছের ৯০ শতাংশ জীবিত রয়েছে। বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে এলাকায় পরিবেশের সাম্যতা অনেকাংশে বেড়েছে।

এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বন্যার পানি জমে থাকতো। এমন কি ঘরবাড়িও ডুবে যেতো। সঠিক সময়ে ধান লাগাতে পারেননি। দেরি হয়ে যেতো। আবার বাকি সময়ে ধান কাটার আগেই চলে আসতো বন্যা। এতে অনেক ধান উঠাতে না পেরে কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়েন। আর এই প্রকল্পের বদৌলতে এখন ঠিক সময়েই ফসল আবাদ করতে পারছেন কৃষকেরা।

বিএমডিএ’র সহকারী প্রকৌশলী সানজিদা খানম মলি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্প এলাকায় সেচ কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের পরিবর্তে মূলত: ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহৃত হচ্ছে; যা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। এছাড়া পুন:খননকৃত খাল/খাড়ীর উভয়পাশে বৃক্ষরোপনের ফলে অনেকাংশে পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষা পেয়েছে। সর্বোপরি জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে এলাকার দারিদ্র বিমোচনে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বর্তমান সময়ের ঝউএ এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত, যা ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও সরকারের ভিশন ২০২১ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও বিএমডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী এ টি এম মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, খালের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এলাকার জমাট বাঁধা পানি নিষ্কাষিত হয়ে জলাবদ্ধতা দূর হচ্ছে। পাশাপাশি সাব-মার্জড ওয়্যার নির্মাণের কারণে শুষ্ক মৌসুমে খালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে প্রকল্প এলাকার ১৪ হাজার হেক্টর এক ফসলি জমিতে বছরে তিনটি ফসল (আউশ/আমন, ইরি/বোরো ও রবি শস্য) আবাদ করা হচ্ছে। প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি অর্জিত হলে প্রকল্প এলাকায় ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টরের অধিক জমিতে চাষাবাদ করে আরো অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো: আব্দুর রশিদ বলেন, মোট সাতটি উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্পের। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রকল্প এলাকার জলাবদ্ধতা দূরিকরণ ও সেচ কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করা, এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি জমিতে রুপান্তর করা, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সৃষ্ট বিরুপ/বৈশ্বয়িক পরিবেশ মোকাবেলা করা, ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ হ্রাস করা, খাল পুন:খননপূর্বক জলাবদ্ধতা দূর করে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

অপরদিকে, পত্নীতলা থানার কৃঞ্চপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, বিএমডিএ’র প্রকল্পের আওতায় ১৪ একর আয়তনের একটি দিঘী রয়েছে এখানে, যার নাম টেপাবিল বা সাতভিলা দিঘী। এই দিঘীর পানি ব্যবহার করে কৃষকেরা অন্তত আড়াই শ’ বিঘা জমিতে ফসল উৎপাদন করে ঘরে তুলতে পারছেন।

ডিসেম্বর ১, ২০১৯ at ১৯:৫৭:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/এমআর/এআই