দলে অনুপ্রবেশকারী ও অপকর্মকারীদের তালিকা প্রধানমন্ত্রী হাতে

দলে অনুপ্রবেশকারী ও অপকর্মকারীদের তালিকা এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তালিকায় থাকারা যেন কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতেই স্থান না পায়, তা নিশ্চিত করতে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে চলা চলমান সম্মেলনে তালিকা দেখে কমিটিতে ঠাঁই দেয়ারও নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ প্রধান।

জাতিসংঘ থেকে ফিরে ভারত সফরের আগের দিন বুধবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ডেকে এমন নির্দেশনার কথা জানান দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় সংগঠনকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনগুলোরও সম্মেলনের নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত রাতেই সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়ে দেয়া হয়।

গণভবনের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের এমন কয়েকজন নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেন। বৈঠকে দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে করা চলমান শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখার বিষয়েও দৃঢ় মনোভাব দেখান শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তার অবস্থান আগের মতোই জিরো টলারেন্স বলে জানান ওই নেতারা।

জানা গেছে, গত মাসে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগের কারণে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তাদের সম্পর্কে প্রায় আড়াই মাসের বেশি সময় গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নেন শেখ হাসিনা।

কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিতর্কিত অনেককেই ঠাঁই দেয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে ভিসির কাছে চাঁদা দাবি, দলীয় কার্যালয়ে বসে দুই নেতার মাদক সেবন, সভাপতি শোভনের বিয়ের অভিযোগ, রাব্বানীর কয়েকটি ফোনালাপ ফাঁসসহ নানা অভিযোগে তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেন তিনি। তারও আগে গণভবনে শোভন-রাব্বানীর প্রবেশের পাস বাতিল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।

এরপর গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কি কমিটির বৈঠকে দুই নেতাকে অব্যাহতি দেন শেখ হাসিনা। ওইদিন বৈঠকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের দুই নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া সম্পর্কে কঠোর মনোভাব দেখান তিনি। এর পরদিন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামে। মতিঝিল, আরামবাগসহ নগরীর বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালায় র‌্যাব ও পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে।

এ ছাড়া যুবলীগের কথিত সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জি কে শামীমকেও তার ছয় দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। জি কে শামীম বিএনপির আমল থেকেই বড় বড় ঠিকাদারি কাজ করতেন। সে সময় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ছিলেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের খুবই ঘনিষ্ঠ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে খোলস পাল্টে জি কে শামীম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করেন।

ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় সরকারের বড় বড় ঠিকাদারি কাজগুলো বাগিয়ে নেন তিনি। এ ছাড়া অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধানকেও আটক করে র‌্যাব। রিমান্ডে ও র‌্যাব হেফাজতে তাদের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। ক্যাসিনো থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসে তাদের জবানীতে। সেসব তথ্য প্রধানমন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি বক্তব্যে বিষয়টি বারবার উচ্চারণ করে আসছেন।

তার প্রতিফলন দেখাতে শুরু করেছেন তিনি। যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয় অভিযান। এ অভিযানকে বলা হচ্ছে ‘শুদ্ধি অভিযান’। যা নিজ দল থেকেই শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি এও বলেছেন, অপকর্মে জড়িত থাকলে দল, পরিবার, আত্মীয় কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

আরো পড়ুন:
মুসলিম বিদ্বেষীর ইসলাম গ্রহণ, কারণ মোহামেদ সালাহ
গ্রেফতার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে দুবাই থেকে দেশে আনা হচ্ছে

এদিকে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পর দেখা যায় এসব অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সম্পৃক্ত। বেরিয়ে আসে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রভাবশালী নেতাদের নাম। আলোচনায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার, যুবলীগের সম্রাট, খালেদসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরের অনেক নেতার কর্মকাণ্ড।

চট্টগ্রামে জুয়ার আখড়ায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামসুল হক এবং তার ছেলের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী অনেকেই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশে করেছে। ঠাঁই করে নিয়েছে দলীয় বিভিন্ন পদ-পদবিতেও। পরবর্তী সময়ে তারাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্মে। এতে সরকার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।

এসব বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সারাদেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সম্মেলন হচ্ছে। এসব সম্মেলনে যাতে অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত ব্যক্তি, কোনো অপকর্মকারী কমিটিতে স্থান না পায় সে ব্যাপারে নেতাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সারাদেশে দলে অনুপ্রবেশকারী, অপকর্ম যারা করেছে তাদের একটা তালিকা তার কাছে আছে।

বিভাগীয় দায়িত্বে যারা আছেন তাদের এই তালিকাটি দেখতে বলেছেন তিনি। তালিকা দেখে যার যার এলাকায় কমিটি গঠনে সতর্ক এবং সজাগ থাকার জন্য বলেছেন; যাতে এই ধরনের লোক আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান না পেতে পারে। চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’ নিয়ে তিনি বলেন, যারা ধরা পড়েছে তারা চুনোপুঁটি নয়। আরো খবর আপনারা (সাংবাদিকরা) পাবেন, এর আওতায় অনেকেই আসবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমাদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি উপজেলা সম্মেলন হয়েছে। সেসব ইউনিটে আমরা সতর্কতার সঙ্গে নেতৃত্ব নির্বাচন করছি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনেও আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করব। যাতে কোনো অনুবেশকারী কোনোভাবেই সংগঠনের কোনো পর্যায়েই আসতে না পারে।

অক্টোবর ০৪, ২০১৯ at ১৩:০৪:২৯ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/ভোকা/এএএম