গোয়েন্দাদের তালিকায় থাকা শতাধিক ব্যক্তি কড়া নজরদারিতে

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার অপকর্মের সঙ্গে জড়িত শতাধিক সহযোগীর নাম এখন গোয়েন্দাদের তালিকায়। এদের ধরতে র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অ্যাকশন নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপি থেকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারের পর তার একের পর এক অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী খালেদ এক সময় ছিলেন ছাত্রদলের কর্মী। পরবর্তী সময়ে ভোল পাল্টে বনে যান যুবলীগ নেতা। খালেদের গ্রেপ্তারের খবর গতকাল বৃস্পতিবার ছিল ‘টক অব দ্য টাউন’। চায়ের দোকান থেকে অফিস আদালতেও এই বিষয়টি সবার আলোচনায় স্থান পায়। খালেদের গ্রেপ্তারের খবরে রাজধানীর খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, কমলাপুর, বাসাবো, সবুজবাগ এলাকার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সরকার চাঁদাবাজি ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার পর থেকে জড়িতদের খুঁজে বের করতে গোয়েন্দাদের একটি তালিকা ও প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। এরপর ৫ শতাধিক শীর্ষ চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের ইন্ধনদাতার নাম গোয়েন্দা তালিকায় উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে এই তালিকা আরো যাচাই বাছাই শেষে ১০০ জনকে নিয়ে অন্য একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এই উভয় তালিকায় ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি স¤্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদের নাম স্থান পায়। তালিকাটি প্রতিবেদন আকারে পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে জমা দেয়া হয়। গত বুধবার গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় অ্যাকশন। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মী টাকার ভাগ পায় তাদের নামও তালিকায় রয়েছে।

এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, র‌্যাব অভিযান শুরু করলেও আমরা বসে নেই। আমাদের একাধিক টিম এখন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি জোরদার করেছে। কোনো তাড়াহুড়া নয়, সময় হলেই আমরাও কাজ শুরু করব। তালিকাটি সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। স¤্রাট ও খালেদ গত বুধবার সকালে দেশত্যাগের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সঙ্গে আরো তিনজন ছিলেন। কিন্তু তারা বিমানবন্দর থেকে আবার একসঙ্গেই ফিরে আসেন। দুপুরের দিকে তারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আলাদা হন। সেখান থেকে সাড়ে ৩টার দিকে খালেদ বাসায় যান। বাসা থেকে দ্রুতই তার আবার বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাসায় আগে থেকেই র‌্যাবের গোয়েন্দাদের নজরদারি ছিল। ফলে খালেদ আর বাসা থেকে বের হতে পারেননি। বাসায় প্রবেশের পরই খালেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে খালেদ র‌্যাব কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।

খালেদের যত অপকর্ম : র‌্যাব ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগের ছত্রছায়ায় খালেদ মূলত আন্ডারওয়াল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন। বেশ কয়েক বছর আগে খালেদের হাত ধরেই ঢাকায় ‘ক্যাসিনো কালচার’ শুরু হয়। গুলশান থেকে শুরু করে মতিঝিল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ক্যাসিনো স্থাপন করে হরেক রকম জুয়ার আসর বসান তিনি। রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, এলিফ্যান্ট রোড ও বনানীতেও ক্যাসিনোর ব্যবসা রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি স্থানেই রমরমা মাদক ব্যবসা রয়েছে। ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে প্রতিরাতে কোটি কোটি টাকা আয় হতো। যুবলীগের পদ পাওয়ার পর তিনি আরামবাগ ও মতিঝিল ক্লাবপাড়ার দখল নেন। রাজনৈতিক দলের নেতারাও ক্যাসিনোর টাকার ভাগ নেন। অনেককে দিতে হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা দামের মোবাইল ফোন। এমন নেতাদের তালিকাও করা হচ্ছে। টাকার ভাগ যেত অনেক সাংবাদিকের পকেটেও। এরই মধ্যে খালেদ সবার তালিকা র‌্যাবের কাছে দিয়েছেন।

র‌্যাবের সূত্রটি বলছে, ক্যাসিনোর এই টাকার ভাগ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও চলে যেত। যেসব সন্ত্রাসী দেশের বাইরে থাকেন তারাই মূলত এই ভাগ পেতেন।

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, খিলগাঁও ও শাহজাহানপুর এলাকার স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ এক সময় রাজধানীর পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। বিএনপিপন্থি সন্ত্রাসী মানিক এখন ভারতে পলাতক রয়েছে। মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানান অপকর্মের হোতা মানিকের ডানহাত হিসেবে কাজ করেছেন খালেদ। কিন্তু এক সময় টাকার ভাগাভাগি নিয়ে মানিকের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। খালেদ তখন রাজধানীর আরেক পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের শেল্টারে চলে যান। জিসান বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থান করছেন। মাঝে মাঝে দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে যাতায়াত করেন। জিসানের সঙ্গে যোগ দেয়ার পর খালেদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজিতে আধিপত্য বিস্তার করেন। এক সময় টাকার ভাগাভাগি নিয়ে জিসানের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটে তার। তখন খালেদ নিজেকে বাঁচানোর জন্য ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাটের কাছে এসে আশ্রয় নেন। নানান কৌশলে পথের কাঁটা জিসানের ক্যাডারদের সরিয়ে নিজের অবস্থান সুসংহত করেন। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে স¤্রাটের ছত্রছায়ায় ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। বিশাল ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে সব ক্যাসিনোর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানান অপকর্মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন খালেদ। মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবীর সঙ্গেও খালেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে নবী ও খালেদের যৌথ হোটেল ব্যবসা রয়েছে। খালেদ মালয়েশিয়ায় অ্যাপার্টমেন্ট কিনে সেকেন্ড হোম করার সুযোগ নিয়েছেন। অবৈধ অর্থ আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দুই বছর আগে বিপিএল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের একটি টিমেরও শেয়ার নেন।

কমলাপুরের ইস্টার্ন টাওয়ারে খালেদের একটি টর্চার সেলে রয়েছে। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে অথবা তার কর্মকাণ্ডে নাক গলালে ক্যাডারদের দিয়ে ওই টর্চার সেলে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব ওই টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে একটি প্লাস, কয়েকটি হকিস্টিক ও লাঠি উদ্ধার করেছে। সংবাদ মাধ্যমে যেন অপকর্ম প্রচার না হয়, সে জন্য বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের মাধ্যমে ম্যানেজ করতেন খালেদ। খালেদ মোটা অংকের বিনিময়ে পুলিশের ওসি থেকে ডিসি এবং জনপ্রতিনিধিদেরও ব্যবহার করতেন।

সুযোগ বুঝে দল পরিবর্তন করা ল্যাংড়া খালেদের পেশা। স্বার্থ হাসিলের জন্য সব সময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেই থাকে। খালেদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে বলেও জানা গেছে। কাওসার, পলাশ, তমাল হত্যা মামলা, মগবাজারে রানা হত্যা মামলা, রামপুরার কৃস্টালে জোড়া খুন, এজাজ মুরাদ হত্যা মামলা, তিলপাপাড়ায় বাবার সামনে ছেলে হত্যা মামলার সঙ্গে খালেদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। কিন্তু প্রভাব ও অর্থের জোরে সে বারবার বেঁচে যায়। কয়েক বছর আগে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দেয়ালে দেয়ালে খালেদের কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়ে গ্রেপ্তারের দাবিতে পোষ্টার দেখা যায়।