পাহাড়ে মরুভূমিতে ছিলাম, ভেবেছিলাম হয়তো বেঁচে ফিরব না

ছবি- সংগৃহীত।

ইয়েমেনে সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার হাতে অপহরণের শিকার জাতিসংঘের কর্মকর্তা বাংলাদেশি নাগরিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এ কে এম সুফিউল আনামকে উদ্ধারের পর দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

বুধবার (৯ আগস্ট) সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে কাজ করার সময় তিনিসহ আর চারজন অপহরণের শিকার হন। সে সময় ইয়েমেনের মুদিয়াহ প্রদেশ থেকে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সদস্যরা তাদের অপহরণ করে।

আরো পড়ুন :

একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করলেন গৃহবধূ
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো কুবিসাসের অবস্থান কর্মসূচি

সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে নেমে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। বর্ণনা করেন গত দেড় বছরে তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্বিসহ ঘটনা। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো আর বেঁচে ফিরতে পারবেন না। তাকে যে কোনো মুহূর্তে হত্যা করা হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে ফিরেছেন।

তিনি নিজের অপহৃরণের ঘটনাকে অ্যাকশন সিনেমার চিত্রনাট্যের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এটা সিনেমায় বা কোনো অ্যাকশন মুভিতে দেখা যায়, আমি আসলে কি অবস্থায় ছিলাম। আমি ছিলাম পাহাড়ে, মরুভূমির মধ্যে। আকাশ বাতাস দেখতে পারিনি মাসের পর মাস।

অপহরণের দিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে ফিরছিলাম তখন আমার সঙ্গে দুটো গাড়ি ছিল, দুজন চালকসহ ৬ জন লোকও ছিল। আমাদের রাস্তার মাঝখানে একটা চেকপোস্টে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। সেখান থেকে একটি পাহাড়ের শেল্টারে নিয়ে রাখা হয়। ভাগ্য ভালো যে, সেখানে আমাদের নিয়ে কোন ধরনের নির্যাতন বা দুর্ব্যবহার করা হয়নি। শুধু চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেখানে যতদিন সম্ভব তারা রেখেছে। এরপর সেখান থেকে আমাদের চোখ-মুখ বেঁধে একটি মরুভূমিতে নিয়ে রেখে দেয়। এভাবে আমরা গত দেড় বছর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। গত দেড় বছর আমাদের অন্তত ১৮ বার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মুভ করানো হয়েছে। মোট ১০টি জায়গায়।

খাবার-দাবার কেমন দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে তিনি বলেন, খাবার দাবার আমাদের ঠিকমতো দেওয়া হয়েছিল। যতদিন পর্যন্ত তাদের ফান্ড ভালো ছিল। ততদিন পর্যন্ত খাবার-দাবারসহ অন্যান্য বিষয়ে কোনো ত্রুটি তারা করেননি। তবে বা টাকা-পয়সা ফুরিয়ে যায়, তখন আমরা অতিবাহিত করেছি কঠিন সময়। আমিসহ পাঁচজন সেখানে বন্দি ছিলাম, বাকি চারজন ইয়ামিনি।

তারা কেন অপহরণ করেছিল সে ব্যাপারে আপনার ধারণা আছে কি না? -জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা আমাদের অপহরণ বা জিম্মি করার মধ্য দিয়ে কি চেয়েছে বা কত টাকা চেয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে, আমি জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা। সেজন্য টার্গেট করা হয়েছে। তবে তারা আমাকে বলেছে তাদের কিছু দাবি দেওয়া রয়েছে, সেগুলো আদায় করার জন্য আমাকেসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়েছিল। আমাকে নিয়ে তারা যেসব ভিডিও ক্লিপ তৈরি করেছে সেখানে তারা স্পষ্ট বলেছে, তারা তাদের কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ চায়। কিন্তু তাদের দাবিগুলো কী, সে ব্যাপারে আমার ধারণা নেই।

নির্যাতন বা দুর্ব্যবহার করা হয়েছিল কি না- এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাকে টর্চার করা হয়নি, তবে মাঝেমধ্যে দুই একজন আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। সেটা খুবই সামান্য।

কখন আপনি বুঝতে পারলেন যে, আপনাকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ লাগবে? -এমন প্রশ্নের জবাবে সুফিউল আনাম বলেন, আমাকে উদ্ধার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ যে প্রয়োজন সেটা আমি গতকাল পর্যন্ত বুঝতে পারিনি এবং গতকাল পর্যন্ত আমি এটাও জানতাম না যে বাংলাদেশ থেকে আমাকে উদ্ধার করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চলছিল।

অপহরণের পর কি আপনার মনে হয়েছিল যে আপনি বেঁচে ফিরতে পারবেন? -এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছে আর বেঁচে ফিরতে পারবো না বা বাঁচবো না। যেকোন বিপদ সংকুলান মুহূর্তে তারা আমাদের হত্যা করতে পারে। আমাদের পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়েছিল। তবে তাদের সেখানে আরো ২/৩ জন বন্দি ছিল। যাদের সঙ্গে তাদের নিজেদের কনফ্লিক্ট ছিল।

আপনাকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টায় আসলে কি কি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা জানেন আমি একটা ভয়ংকর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে অপহরণের শিকার হয়েছিলাম এবং বিষয়টা ছিল খুবই স্পর্শকাতর। আমি নিরাপত্তার স্বার্থে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা করতে অপারগ। কারণ আমার কোনো বক্তব্য যদি তাদের অপছন্দ হয়, তবে আবারও আমাকে চেজ করতে পারে। আমি আসলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে চাই না।

আপনার সঙ্গে থাকা বাকি ইয়ামিনি চার নাগরিককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না? -জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, বাকি চারজনকেও তাদের সরকারের হাতে হস্তান্তর করার কথা। গতকাল বা আজকের মধ্যে তাদের হস্তান্তর করা হয়ে থাকতে পারে।

আবারও এমন বিপদ সংকুল কাজে যাবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত দেড় বছরে গতকালই মাত্র একদিন আমার পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি একজন প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা। আমার কাজই এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজে যাওয়া। আমি দেশের প্রয়োজনে এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজে যেতে পিছপা হবো না।

আপনাকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কি ধরনের সহযোগিতা করেছে? -জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতিসংঘ আমাকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে কি ধরনের সহযোগিতা করেছে তা আমার এই মুহূর্তে জানা নাই। তবে আমি জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা হিসেবে জানি, এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এর আগেও অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেছে। আমি নিজেও এ ধরনের উদ্ধার কাজে জড়িত ছিলাম। তবে আপনারা জানেন জাতিসংঘের কিছু নিয়ম আছে। তারা সরাসরি কোন দেশে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বা নিরাপত্তার বিষয় হস্তক্ষেপ করে না। তাদের যদি কোনো উদ্ধার কাজের প্রয়োজন হয় তবে তারা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মাধ্যমে করে। এক্ষেত্রে সেই দেশের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে যে হোস্টেসকে উদ্ধার করা সম্ভব কি না।

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমি যখন সুদানে কাজ করি তখন জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। তখন তার উদ্ধারের ব্যবস্থাপনায় আমিও ছিলাম। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপে আমরা তাকে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম।

বিমানবন্দরে এনএসআই পরিচালক ইমরুল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সুফিউল আনাম স্যার অপহরণের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ছিল। স্যারকে উদ্ধার করার ব্যাপাটি একদিনে হয়নি। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ও দুরূহ কাজ ছিল আল-কায়েদার মত জঙ্গি গোষ্ঠীর হাত থেকে এমন মানুষকে উদ্ধার করা। এই উদ্ধার কাজে আমরা আমাদের কিছু বন্ধু প্রতীম দেশ, সংস্থা ও আরও অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

তিনি বলেন, সত্যি বলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল যে আমরা যেন এই উদ্ধার কাজে সফল হই। প্রধানমন্ত্রী এনএসআইয়ের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এনএসআই প্রধানমন্ত্রীর সম্মান ও আস্থা মূল্য দিতে পেরেছে, সেজন্য আমরা গর্বিত বোধ করছি।

ভবিষ্যতেও জাতীয় নিরাপত্তায় যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় এনএসআই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক নিরাপত্তার হুমকি সন্মুখীন হোক না কেন আমরা তাদের উদ্ধারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

উদ্ধার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, স্যারকে উদ্ধার করা বিষয়টি একদিনের নয়। এটা ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া। স্যার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমরা কাজে লেগে পড়ি। বাংলাদেশ থেকে এটা অনেক দূরে, তিনি যেখান থেকে অপহৃত হয়েছিলেন। তার অবস্থা অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে। এজন্য অনেকবার অনেকভাবে যোগাযোগ করতে হয়েছে। নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা এর বেশি কিছু বলছি না।

‘আলহামদুলিল্লাহ, আমরা শেষ পর্যন্ত স্যারকে সুস্থ ও নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। স্যারকে মুক্ত করার জন্য তারা মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল। তবে কোনো ধরনের মুক্তিপণ ছাড়াই কিন্তু আমরা স্যারকে উদ্ধারে করে আনতে পেরেছি। এটা আমাদের বড় সাফল্য।’

আগস্ট ০৯, ২০২৩ at ২০:৫৬:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর