আজ যশোর মুক্ত দিবস

যশোর হানাদার মুক্ত হওয়ার ৫১ বছর।

যশোর হানাদার মুক্ত হওয়ার ৫১ বছর। আজ যশোর মুক্ত দিবস। ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয় যশোর জেলা। এই মাটিতে সেদিন উড়েছিল বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সূর্য খচিত গাঢ় সবুজ পতাকা। ডিসেম্বরের শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো এলাকা বা মহল্লা মুক্তিসেনার নিয়ন্ত্রণে আসলেও জেলার কেন্দ্রবিন্দু এবং পাকসেনাদের শক্তিশালি ঘাঁটি যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল হয় এই প্রথম। এদিন বিকেলের আগেই মুক্তিসেনাদের সহায়তায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী পৌঁছে যায় যশোর ক্যান্টনমেন্টে।

দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যশোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত দিবস। ১১ ডিসেম্বর যশোরের ঐতিহাসিক টাউন হল মাঠে স্বাধীন বাংলায় প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মহান বিজয়ের মাস উপলক্ষে যশোরে জেলা প্রশাসন স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন মাসব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে সকালে টাউন হলমাঠ থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বেরিয়ে শহরের বকুলতলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালে গিয়ে শেষ হবে। এ ছাড়া আলোচনাসভাসহ নানা কর্মসূচি রয়েছে।

এর আগে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যশোর শহরে মুক্তিকামী জনতার জঙ্গি মিছিলে পাক বাহিনী গুলি চালালে শহীদ হন চারুবালা কর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই প্রথম শহীদ। এর পর যশোরে সংগঠিত হতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের আন্দোলনকারীরা। এর নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও নারীদের। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য মশিয়ুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৯ মার্চ পাকবাহিনী যশোর শহর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়।

আরো পড়ুন:
>যশোর শিল্পকলা একাডেমির নতুন কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ
>কোয়ার্টার ফাইনালে অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিল

৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই এখানে শহীদ হন। ৩০ ও ৩১ মার্চ মুক্তিকামী জনতা মিছিল সহকারে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা চালায়। মুক্তি পায় সব রাজবন্দি। জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকে।

কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট তখন খালি। পাকসেনারা তার আগেই ক্যান্টনমেন্টে ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিসেনারা দেখতে পায় খাবার টেবিলে প্লেটে খাবার। পড়ে আছে ভাত তরকারি। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতে খাবার ফেলেই স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যায় পাকসেনারা। মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান রবিউল আলম বলেন, ৭১’র ৩ মার্চ যশোর কালেক্টরেটের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে যশোরবাসী শপথ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের। শহরের রাজপথে বের হয় জঙ্গি মিছিল। এই মিছিলে গুলি চললে শহিদ হন চারুবালা কর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই যশোরের প্রথম শহিদ।

এরপর থেকেই যশোরে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ। নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও মহিলাদের। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য মশিয়ূর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে যশোর সেনানিবাসে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৯ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী যশোর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। ৩১ মার্চ নড়াইল থেকে হাজার হাজার লোকের বিশাল এক মিছিল আসে। শহরবাসীর সাহায্যে সশস্ত্র মিছিলটি হামলা চালায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্তি পায় সব রাজবন্দী।

আরো পড়ুন:
>যশোর শিল্পকলা একাডেমির নতুন কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ
>কোয়ার্টার ফাইনালে অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিল

এর আগে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে। পাকবাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই শহিদ হন। রবিউল আলম জানান, জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকে। যশোর মুক্তিযুদ্ধের ৮নম্বর রণাঙ্গন। কমান্ডার ছিলেন তদানীন্তন মেজর মঞ্জুর। অন্যদিকে, পাক বাহিনীর মোতায়েন ছিল ১০৭ নম্বর ব্রিগেড। এর কমান্ডার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুবাহিনী ৬টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করতো।

২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। পাক বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের শক্তিশালি ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী। মিত্র বাহিনীর গোলার আওতায় আসে যশোর সেনানিবাস। ২২ নভেম্বর রাতে পতন হয় চৌগাছার। হানাদার বাহিনী সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এ সময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। এ অঞ্চলের পাক বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান প্রাণ ভয়ে তার অফিস স্থানান্তর করেন খুলনায়। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান শুরু হয় ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাক বাহিনী পালিয়ে যায় খুলনার দিকে।

৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর থেকেই মুক্তিবাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বুকে লালন করে চোখের জল মোছেন চৌগাছার মশ্মিমপুরের আইয়ুব আলীর মা। বালক আইয়ুব আলী একমাত্র অপরাধ সে আওয়াজ তুলে ছিল ‘জয় বাংলা’। এই অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এমনি অনেক ত্যাগের ও বেদনার কাহিনী ছড়িয়ে আছে যশোর জেলার সর্বত্র।

পাক হানাদার ও তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামির রাজাকার আল-বদরদের হাতে নৃশংস হত্যার শিকার হন আইনজীবীদের মধ্যে মশিয়ূর রহমান, সুশীল কুমার রায়, সৈয়দ আমির আলী ও আব্দুর রসিদ খান, বাঘারপাড়া থানা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুল কাদের, আবু তালেব, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ সুলতান অধ্যাপক নবীন চন্দ্র, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নারায়ণ সাহা, সমাজসেবী সুধির ঘোষ, নাট্য অভিনেতা অমল সোম, চিকিৎসক ওবায়দুল হকসহ অসংখ্য বাঙালি সন্তান।

আরো পড়ুন:
>যশোর শিল্পকলা একাডেমির নতুন কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ
>কোয়ার্টার ফাইনালে অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিল

এদিকে, দিবসটি পালন উপলক্ষে আজ ৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় টাউনহল ময়দান থেকে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গণ-র‌্যালি। র‌্যালিটি শহর প্রদক্ষিণ করে বকুলতলাস্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে শেষ হবে। বিকেলে টাউন হল ময়দানের রওশন আলী মঞ্চে পরিবেশিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

ডিসেম্বর ০৬.২০২২ at ০৯:৪০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/ এসআর