শিবগঞ্জে উথলী বাজারে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নবান্নের মাছের মেলা

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলীতে গতকাল মঙ্গলবার বসেছিলো হরেক রকম মাছের মেলা। দূর-দুরান্তের মানুষ এসেছেন মাছ কিনতে। ছোট বড় সব সাইজের মাছ পাওয়া গেছে মেলায়।

মেলায় এক হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে। এক কেজি থেকে শুরু করে ১৫ কেজি ওজনের চিতল, ১৩ কেজি ওজনের কাতল, রুই, কাতলা, বিগহেড, ব্ল্যাককাপ, সিলভার কার্পসহ হরেক রকমের মাছ বিক্রি হয় মেলায়। তবে গত বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম অনেকটায় বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা।

বিশালাকৃতির রুই-কাতলা ও মাছগুলো আটশ‘ থেকে এক হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ৪২০ টাকা থেকে সাতশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২৪০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে ব্ল্যাককাপ, বিগহেড ও সিলভার কার্প মাছ বেচাকেনা হয়। শত বছরের প্রাচীন উথলী মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের ২২ গ্রামে স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

পঞ্জিকানুসারে মঙ্গলবার পহেলা অগ্রহায়ণ হওয়ায় এদিন নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর মাছের মেলা বসে উথলীতে। নবান্ন উৎসব হলেও উথলী, রথবাড়ি, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবিপুর, গুজিয়া, মেদনীপাড়া, বাকশন, রহবল, মোকামতলাসহ ২২ গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে ছিলো উৎসবের আয়োজন। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানের চালে নবান্ন করেন।

নবান্ন উপলক্ষে সেখানে মাছের মেলা বসলেও জমি থেকে নতুন তোলা অন্যান্য শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে। এই মেলায় নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়াও মিষ্টি আলু ও কেশর(ফল) প্রতি কেজি দেড়শ‘ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
শিবগঞ্জের উথলী এলাকার মাছ ব্যবসায়ী গোপাল দাস, জহুরুল ইসলাম জানালেন তিনি গাবতলী উপজেলার ডাকুমারা এলাকায় নিজ উদ্যোগে মাছ চাষ করেন। এবার তাঁর পুকুরে চাষ করা দুটি ১২ কেজির ওজনের কাতলা এনেছেন। তার দাম চেয়েছেন ১২ হাজার টাকা।

অপর মাছ বিক্রেতা শিবগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের মোমিন মিয়া জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্ততঃ ৫ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।

মেলায় আড়ৎ খুলে বসা আলীয়ার হাটের একতা মৎস্য আড়তের সত্ত্বাধিকারি মোনায়েম আহমেদ বলেন, অধিকাংশ আড়ৎদার পিকআপভ্যান ও ভটভটিতে করে মাছ এনে নিমিষেই পাইকারি দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, পুরো মেলার ২০ জন আড়ৎদার মিলে কোটি টাকার ওপরে মাছ বিক্রি করেছেন।

মেলায় মাছ কিনতে এসে বেড়াবালা গ্রামের মছির উদ্দিন ও রহবল গ্রামের সুখেন চন্দ্র দাস জানান, উথলীর নবান্ন মেলায় বিক্রির জন্য আশপাশের এলাকার পুকুরগুলোতে সৌখিন চাষীরা মাছ মজুদ করে রাখেন। এলাকার কে কতো বড় মাছ মেলায় তুলতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতা চলে চাষীদের মধ্যে। এছাড়া আড়ৎদাররা তো আছেই। এলাকার লোকজনও প্রায় প্রতিযোগিতা করে তুলনামূলক বড় মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে যায়। মূলতঃ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব করলেও আশপাশের গ্রামের সকল সম্প্রদায়ের মানুষই কেনাকাটা করে।

উথলী গ্রামের বাসিন্দা অর্জুন কুমার মোহন্ত জানান, প্রায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি মেলার দিন নতুন শাক-সবজিতেও ভরপুর থাকে। একারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসে। তিনি বলেন, শুধু যে মাছ আর সবজিই নয়, মেলার আবহের জন্য সেখানে শিশু- কিশোরদের খেলনার দোকান বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসেছে মেলা চত্বরে।

উথলী বাজারের ইজারাদার ওমর ফারুক জানান, আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু আশেপাশেরই নয় পুরো শিবগঞ্জ উপজেলার মানুষ এখানে নবান্নের বাজার করতে আসেন। মাছের মেলার খবর পেয়ে শহর থেকেও অনেকে সেখানে ছুটে যান মাছ কিনতে। এবার মেলায় দেড় হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে বলে তিনি জানান।

১৭ নভেম্বর, ২০২০ at ১৯:৪৪:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএম/এমএআর