মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ : ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। কিন্তু এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরো অনেক সংগ্রামের ইতিহাস।

আজ সেই সংগ্রামের দিন, ইতিহাস গড়ার দিন, ভাষা রক্ষার আন্দোলনের দিন, মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস।

যেভাবে ভাষা আন্দোলনের সূচনা : ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ।’ ওইসময় বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি এই চারটি ভাষার পক্ষ-বিপক্ষে নানান মত ছিল। আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের স্যাকুলার জাতীয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে।

১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদি পত্রিকায় লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরির যোগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলাভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন।’ আর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথা চারা দিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে অর্থনীতি ও রাজনীতিও সেই বিতর্কের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।

অবিশ্বাসের বীজ বপন : ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাক টিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড প্রভৃতি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

কমিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে। যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ : ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিসের নূরুল হক ভূঁইয়া, তৎকালীন সংসদ সদস্য সামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা অলি আহাদ, ছাত্রনেতা (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অনেকেই এর সদস্য ছিলেন যারা শুরুতে গোপনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।

জিন্নাহর দম্ভ : ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সমাবেশে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’ ওই সমাবেশেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জিন্নাহর মৃত্যুর পরও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানা রকম প্রস্তাব, পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলে।

এই আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ংকর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয় বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি যখন পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহর কথাই পুনরাবৃত্তি করেন খাজা নাজিমুদ্দিন। সে সময়ও একইভাবে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে বাঙালি।

একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে যা ঘটেছিল : খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে পরদিন থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল। যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। যা লঙ্ঘন করেই জন্ম হয়েছিল শহীদ দিবসের।

১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ঢাবি শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষের মিছিল বের হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছেই গুলিবর্ষণ হয়েছিল শিক্ষার্থীদের ওপর।
ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন সে বিষয়ে সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। সেদিন এবং পরদিন পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরো অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজ বপন : রক্তে কেনা মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তা কখনোই এক রাষ্ট্র হতে পারে না। ভাষা আন্দোলনের দুই বছরের বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর। মাতৃভাষা নিয়ে এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।

আজ মহান একুশে : আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

এছাড়া আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরানখানির আয়োজনসহ দেশের সব উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।

কর্মসূচি : একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, তিন বাহিনী প্রধানের শ্রদ্ধা জানানোর পর শহীদ মিনার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এদিকে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং প্রভাতফেরি। পরদিন বুধবার বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন।