জলাবদ্ধতায় নাকাল বরিশালের মানুষ

ছবি- সংগৃহীত।

ধান-নদী-খাল এই তিন এ বরিশাল কথাটি শুধু প্রচলিতই নয়, শাব্দিক অর্থে সত্যও বটে। এই বরিশালেরই প্রাণ কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থান বরিশাল শহরের। কালের বিবর্তনে আজ তা সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়েছে। ছোট্ট শহরটি আজ ৫৮ বর্গ কিলোমিটারের মেগা সিটি। বিশ বছর পূর্বে সিটি করপোরেশনের যাত্রা শুরু হলেও নাগরিক সুবিধায় এখনো অনেকটাই পিছিয়ে বাংলার ভেনিস বলে খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের নদীমাতৃক এ শহরটি। আগামী ১২ জুন সিটিবাসী ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে যাচ্ছে নগরপিতাসহ সিটি পরিষদ।

ভোটের আগে প্রার্থীদের কাছে নাগরিকদের অভিযোগেরও শেষ নেই। এ কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই ৭ মেয়র প্রার্থীসহ ১৫৮ কাউন্সিলর প্রার্থীই সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন অহরহ। কিন্তু নির্বাচনের পর প্রতিশ্রæতিগুলো বাস্তবায়িত হবে- এমন আশা করছেন না বরিশালবাসী। ২০১৮ ও ২০১৩ নির্বাচনের আগেও সে সময়কার প্রার্থীদের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বরিশাল নগর যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে।

আরো পড়ুন :
> সুপেয় জলের তীব্র সংকট জলজটের খুলনায়
> কাজিপুরে আগুনে পুড়েছে ৭ পরিবারের বসতবাড়ি

বরিশাল শহরের প্রধান সমস্যা- সামান্য বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট, তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, অফিসগামীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে যারা ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত এ পানি পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেন- তারা আক্রান্ত হন চর্মরোগ, পেটের পীড়াসহ নানান ব্যাধিতে। সিটি করপোরেশনের বর্ধিত অংশের চিত্র আরো করুণ। সেখানে না আছে রাস্তাঘাট, ড্রেন, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।

সিটির মধ্যে ২২টি খাল থাকলেও তাতে পানি প্রবাহ নেই। খালগুলো ভরে আছে ময়লা-আবর্জনায়। এসব খালের পানির উৎসমুখ কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে সংযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে জোয়ার ভাটা হলেও খালগুলোতে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। মাঝে মধ্যে খাল খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও কায়েমী স্বার্থবাদী

প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি জেলখাল, লাকুটিয়া খাল, নবগ্রাম খাল দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে এসব খালকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। একই অবস্থা পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ড্রেনেজগুলোর। ময়লা-আবর্জনা পরিপূর্ণ থাকায় ড্রেনেজগুলো কোনো কাজে আসছে না। ফলে নগরবাসী বার বার জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডাক্তার মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, জলাবদ্ধতা সমস্যার নিরসন হওয়া দরকার। জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে। কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চটকদার কথা বলে প্রতিশ্রæতি দেন। নির্বাচন গেলে তা ভুলে যান।

তার মতে, এসমস্যা একা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে জেলা পরিষদ, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও। সমন্বিত পরিকল্পনা করে কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে খালগুলোর উৎসমুখে প্রয়োজনীয় ড্রেজিং করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আউটলেট ড্রেনগুলো পরিস্কার ও সংস্কার করতে হবে। তাহলেই সমস্যা সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা, কার্যকরী উদ্যোগ আর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এনায়েত হোসেন শিবলু ভোরের কাগজকে জানান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম এমপি পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৭টি খাল খননের উদ্যোগ নিলেও সিটি মেয়রের সঙ্গে দ্ব›েদ্বর কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। তার মতে, একারণে ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সমস্যার সহজ সমাধান হবে বলে তার বিশ্বাস।

জেলা কবিতা পরিষদের নেতা অধ্যক্ষ তপংকর চক্রবর্তী বলেন, সিটির ৪০ ভাগ বর্ধিত অংশে কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এ এলাকার নাগরিকরা সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় রয়েছে। নদীতে জোয়ার কিংবা সামান্য বৃষ্টিতেই এ অঞ্চল তলিয়ে যায়। দুর্ভোগের সীমা থাকে না এলাকাবাসীর। তিনিও আশাবাদী আগামী দিনের মেয়র ও কাউন্সিলর মিলে বর্ধিত অংশের সমস্যার সূরাহা করবেন। নচেৎ এ দৈন্যতা থেকেই যাবে।

বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন মেয়র প্রার্থীরাও। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত) তার নির্বাচনি ইশতেহারে নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারসহ নতুন ড্রেনেজ নির্মাণ, নগরীর খালসমূহ খননের বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস তার নির্বাচনী ইশতেহারেও শহরের ঐতিহ্যবাহী খালসমূহ খনন ও সংস্কার করে পুনরুদ্ধারসহ দুপারে সৌন্দর্য্য বর্ধন ও ফুটপাত নির্মাণ প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী দিঘি ও পুকুর সংস্কার করে পরিবেশবান্ধব পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের আশ্বাসও দেন এই মেয়র প্রার্থী।

ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল করীম তার নির্বাচনী ইশতেহারে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য আধুনিকমানের ড্রেন নির্মাণ, খাল খনন করে পরিকল্পিত ইউলিটি টানেল ও স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণ, স্লুইজগেট ও পানি নিষ্কাশন পাম্পের মাধ্যমে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপন ভোরের কাগজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননসহ বিভিন্ন প্রকল্প নেয়ার কথা জানান।

জুন ০৯, ২০২৩ at ১০:১৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর