সুপেয় জলের তীব্র সংকট জলজটের খুলনায়

ছবি- সংগৃহীত।

আর মাত্র দুদিন পর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় সরগরম খুলনা ও বরিশাল। ভোটের আগে আলোচনায় দুই সিটির নাগরিক সমস্যা। ভোটাররা জানাচ্ছেন তাদের প্রত্যাশার কথা। তারা চান সমস্যার সমাধান। নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবেন- এমন কাউকে দেখতে চান মেয়র পদে। ভোটের প্রচারণায় প্রার্থীরাও ছড়াচ্ছেন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ও মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে খুলনা ও বরিশালের নাগরিক সমস্যা নিয়ে আমাদের পৃথক দুটি প্রতিবেদন।

দেশের অন্যান্য মহানগরীর মতো খুলনাতেও সমস্যার যেন শেষ নেই। নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রশস্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও অন্য সড়কগুলোর চিত্র ভিন্ন। অলি-গলি ও ছোট রাস্তাগুলোয় ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা সুসংহত না হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা খুলনা মহানগরীর পুরনো দিনগুলোকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ- নির্বাচনের আগে মেয়র প্রার্থীরা উন্নয়নের আশ্বাস দিলেও নির্বাচনের পরে তা ভুলে যান।

সুশীল সমাজ বলছে, আর মাত্র দুদিন পরেই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কিন্তু এখানে কোনো উৎসবের আমেজ নেই। মানুষের ভেতরে কাজ করছে হতাশা আর উৎকণ্ঠা।

আরো পড়ুন :

> কাজিপুরে আগুনে পুড়েছে ৭ পরিবারের বসতবাড়ি
> শার্শায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় আবর্জনার স্তূপ জমেছে, পানি সরছে না। সব এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো নয়। কিছু এলাকায় ড্রেন আছে, তবে বৃষ্টি হলেই সেগুলো ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ এলাকায় ড্রেনেজ সিস্টেম একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

নগরীর ৮নং ওয়ার্ডের খালিশপুর এলাকার বাসিন্দা মিনহাজুল আবেদীন জানান, সামান্য বৃষ্টি হলেই ড্রেনগুলো ভরে রাস্তায় হাঁটু সমান পানি জমে যায়। জনগণকে ভীষণ কষ্ট করে চলতে হয়। কখনো যানবাহন নষ্ট হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। মহানগরীর পাশেই বয়ে চলেছে রূপসা নদী ও ভৈরব নদ। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না হওয়ায় এগুলোর নাব্যতা কমে গেছে। বৃষ্টি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে শহরের পানি আর নদীতে গিয়ে পড়ে না। এতেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও অপ্রতুল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, খুলনায় ২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার পয়ঃনিষ্কাশনের কাজ সিটি করপোরেশন বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রকল্পের কাজে ধীরগতি এবং বিভিন্ন অভিযোগের কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে। নির্বাচনের পর তা আবার শুরু হবে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে প্রায় ৩০ হাজার বাড়ি থেকে পয়োবর্জ্য পাইপলাইনে নেয়ার পরিকল্পনা এই প্রকল্পে রয়েছে।

নগরীর নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা মেহেদী আজাদ জানান, ড্রেনগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। পাশাপাশি সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। এসব জায়গায় পানি জমে মশার বংশবিস্তার ঘটছে। এ কারণে খুলনা মহানগরীতে মশার উৎপাত চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিকাল থেকেই ঘরে ঘরে মশার উৎপাত শুরু হয়। মশক নিধনে সিটি করপোরেশন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

তিনি বলেন, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মেয়েদের ইভটিজিং করেই চলছে। বর্তমান মেয়র গত নির্বাচনের সময় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নির্মূলের ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু পরে আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। কিশোর গ্যাং এবং ইভটিজারদের দৌরাত্ম এতটাই প্রবল যে অনেকেই এখন আর এসব বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বা অভিযোগ করতে যায় না। গত পাঁচ বছরে তরুণ প্রজন্মের জন্য খেলাধুলা বা বিনোদনের উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ পর্যন্ত যারাই মেয়র হয়েছেন তারা সবাই নতুন প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য আধুনিক খুলনা মহানগরী গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু কেউই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেননি।

সন্ত্রাস খুলনা মহানগরীতে নগরবাসীর একটি বড় সমস্যা। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাড়া-মহল্লায় ছিনতাই-রাহাজানি, মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে বা আশপাশে ইভটিজিংয়ের ঘটনাও ঘটছে। এসব কারণে খুলনা মহানগরীর সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন।

গরিব ও একেবারে সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবায় সিটি করপোরেশন বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে অভিযোগ করছেন নগরীর বাসিন্দারা। এখানে গরিবদের জন্য সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যারা অর্থবান তারাই বড় বড় হাসপাতালগুলো থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ বলতে গেলে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।

খালিশপুর জুট মিলের সাবেক শ্রমিক জয়নাল মিয়া বলেন, দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গরিব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু আমরা এ ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সিটি করপোরেশন থেকে পাই না। কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা এখানে নেই বললেই চলে। খুলনায় সুপেয় পানির অভাব বেশি। ওয়াসার পানি দুর্গন্ধময়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ সরকার বলেন, এবারের খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে এখানে কোনো উৎসবের আমেজ নেই। নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। আগামীতে নাগরিক সুবিধা কতটা বাড়বে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কর্মসংস্থানযোগ্য কোনো প্রকল্প নেয়া হয়নি।

এডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, নগরীর যানজট নিরসন, রাতে মশার উৎপাত, বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা দূর করতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। নগরবাসীর, বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ও তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ বা বিনোদন কেন্দ্র করা খুবই জরুরি।

এসব বিষয়ে বর্তমান মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, করোনা মহামারির কারণে ৩ বছর কোনো কাজ করা সম্ভব হয়নি। কাজ করার জন্য লোকজনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এত বড় একটা মহামারির পর সিটির কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সমস্যাও ছিল। নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে আমি আগামীতে মেয়র নির্বাচিত হয়ে এলে বৃহত্তর পরিকল্পনা নিয়ে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনবদ্ধতা নিরসন, নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা, অনুন্নত ওয়ার্ডগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো হবে।

জুন ০৯, ২০২৩ at ১০:১৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর