তিন জটে নাকাল গাজীপুর

গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠনের পর গত এক দশকেও বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। উল্টো ঘাড়ে চেপেছে বাড়তি করের বোঝা। রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সামান্য কিছু উন্নয়ন হয়েছে। তবে নগরীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা, যানজট ও আবর্জনার জট নগরবাসীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণের অভিযোগ। এছাড়া মাদক-সন্ত্রাসের মতো সমস্যা থেকে মুক্তির পাশাপাশি গাজীপুর শহরকে একটি নিরাপদ ও আধুনিক নগরী হিসেবে দেখতে চান ভোটাররা।

সোমবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সাধারণ ভোটার ও স্থানীয় বাসিন্দারা ভোরের কাগজকে এসব দাবি জানিয়েছেন।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পনগরী টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা এবং গাজীপুর সদর উপজেলার কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, বাসন, পুবাইল, গাছা ও কাউলতিয়া ইউনিয়নের সমন্বয়ে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ৩৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই সিটিতে রয়েছে ৫৭টি ওয়ার্ড। প্রায় ৫০ লাখ জনসংখ্যার এই শহরে ভোটার ১২ লাখের কাছাকাছি। গত ১০ বছরে দুজন নির্বাচিত মেয়র পেয়েছে নগরবাসী। প্রথমজন বিএনপির এম এ মান্না (প্রয়াত), আর দ্বিতীয়জন আওয়ামী লীগের (বর্তমানে বহিষ্কৃত) জাহাঙ্গীর আলম। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ১০ বছরে নানা প্রকল্প হাতে নিলেও বেশির ভাগ এলাকার মানুষ এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না।

আরো পড়ুন :
> সাভারে প্রভাবশালীদের দখলে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের শত শত একর জমি
> ঝিনাইদহে খোকন হত্যা মামলার রায়ে ৬ জনের যাবজ্জীবন

২০১৩ সালে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিএনপির এম এ মান্নানের কাছে হেরে যান আজমত উল্লাহ খান। পরে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়ে চমক দেখান জাহাঙ্গীর আলম। তিন বছর চেয়ারে থাকার পর একটি বিতর্কিত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। এরপর মেয়র পদ থেকেও তাকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এবার আগামী ২৫ মে সিটি করপোরেশনের তৃতীয় মেয়াদে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ফের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন আজমত উল্লাহ খান। নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। বিএনপি থেকে সরাসরি কেউ প্রতিদ্বন্ধিতায় না থাকলেও বিএনপি পরিবারের সদস্য আহসান উল্লাহ মাষ্টার হত্যা মামলার আসামি নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে সরকার শাহ্নুর ইসলাম রনি মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আজমত উল্লাহ খান এবং জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন ছাড়া আরো ৬ জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া ২৪৭ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৭৯ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ভোটের মাঠের সমীকরণ ততই স্পষ্ট হচ্ছে। সবাই নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সাধারণ ভোটাররাও প্রার্থীদের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। ভোটাররা নাগরিক সুবিধা সহজতর করাসহ মাদক-সন্ত্রাস ও সামাজিক সমস্যা দূর করার মতো প্রতিশ্রুতিশীল জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার কথা বলেন।

নাগরিকদের মতে, এক দশক আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলেও আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। প্রথম নির্বাচনে বিএনপি থেকে এম এ মান্নান মেয়র নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগীতা না পাওয়ায় তেমন কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে পারেননি। এছাড়া তিনি মাত্র তিন বছর চেয়ারে থাকতে পেরেছিলেন। বাকি সময় তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম। নির্বাচিত হওয়ার পর শুরুতেই তিনি দেশি-বিদেশী ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় জলাবদ্ধতা নিরসন, যানজট নিরসন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রাস্তাঘাটসহ ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেন। এর মধ্যে গাজীপুরের মূল সড়কগুলোসহ অলিগলির সড়কের প্রায় ৯০ পার্সেন্ট কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তিন বছর পর তিনি মেয়র পদ থেকে বহিষ্কৃত হলে চলমান কাজগুলো থমকে যায়। যা গাজীপুরের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে স্থানীয় নাগরিকদের অভিমত। বর্তমানে নগরীর মূল সমস্যা জলাবদ্ধতা, যানজট ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি ঘটেনি। একটু বৃষ্টি হলেই বেশির ভাগ ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এসব সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নগরবাসী।

নগরীর প্রাণকেন্দ্র ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের চৌরাস্তা এলাকার স্থানীয় পাঁচজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় গতকাল সোমবার। জলাবদ্ধতা, মাদক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যার কথা জানান তারা। রাস্তার পাশে ডিম-রুটি বিক্রেতা হারুনুর রশিদ বলেন, রাস্তাঘাট, ড্রেনের কাজ রয়েছে। কোথাও তেমন পাকা রাস্তা বাকি নেই। তবে একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এছাড়া ময়লা নিয়ে সমস্যা রয়েছে জানিয়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ডাস্টবিন স্থাপনের দাবি তার। এই ওয়ার্ডের তরুণ ভোটার স্বপন চন্দ্র দাস এবারই প্রথম ভোট দেবেন। স্বপন বলেন, যেই নির্বাচিত হোক না কেন তাকে যুবসমাজের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। তাকেই মানুষ ভোট দেবে, যিনি কাজ করেন এবং যিনি জনসম্পৃক্ত ছিলেন।

নগরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বশির আহমেদ বলেন, সিটি করপোরেশন হলেও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কিছুই আমরা পাইনি। শুধু করই দিয়ে যাচ্ছি। ওয়ার্ডভিত্তিক শিশুদের বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ ও কবরস্থান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ির কারণে উঠতি বয়সিরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা, যারা নির্বাচিত হবেন তারা এগুলোর দিকে নজর দিবেন। নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রধান সমস্যা যানজট। এখানে জয়দেবপুর সড়কের রেলগেট এলাকায় যানজটে প্রতিদিন মানুষকে নাকাল হতে হয়। এই জায়গায় প্রতিদিন ৭২টি রেল আসা-যাওয়া করে। ফলে সারাদিনই রেল সিগন্যাল পড়ে থাকে। কখনো কখানো এই সিগন্যালে আধা ঘন্টা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। এসময় উভয়পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এখানে আদালত, ডিসি ও এসপি অফিসসহ প্রশাসনের সব গুরুত্ব অফিস এবং হাসপাতাল থাকায় এই সড়কে হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। দিনে অন্তত পাঁচ কর্ম ঘন্টা নষ্ট হয় এই সিগন্যালে। ভোগান্তির শিকার স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত ৫০ বছর কত মন্ত্রী-এমপি আসলো, এই সমস্যার সমাধানে আশ্বাস দিলেও কোনো কাজ হয়নি। বর্তমানে অত্র এলাকার সাধারণ মানুষের একটাই দাবি, যানজটমুক্ত জয়দেবপুর।

যানজটে দুর্ভোগের কথা জানিয়ে স্থানীয় অটোচালক মফিজ মিয়া বলেন, এখানে যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী। যানজটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কেউ নগরবাসীকে এটা থেকে মুক্তি দিতে পারল না।

তার কথার রেশ টেনে অটোতে থাকা যাত্রী ইমাম হোসেন বলেন, ভাই আমাদের এখানকার সমস্যাগুলো নিয়ে একটু ভালো করে লেখেন। যারা সামনে নির্বাচিত হবেন তারা যেন সমস্যাগুলো থেকে আমাদের মুক্তি দেন।

এদিকে, নগরীর টঙ্গী আর জয়দেবপুর ছাড়া পুরো নগরীতে সাপ্লাই পানির ব্যাপক সংকট রয়েছে। বেশির ভাগ এলাকায়ই নিজস্ব উদ্যোগে গভীর নলকূপ কিংবা টিউবওয়েল বসিয়ে পানির সমস্যা সমাধান করছেন। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের পাজুলিয়া এলাকার বাসিন্দা আকলিমা খাতুন বলেন, সিটি করপোরেশন হলেও আমরা এর সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের গ্যাস নাই, পানি নাই। বিদ্যুৎ সমস্যাও প্রকট। এটা কিসের সিটি করপোরেশন? ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রইজউদ্দিন বলেন, ডাস্টবিনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তার মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ফলে নানারকম রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে নিস্কৃতির দাবি জানান তিনি। এছাড়া গাজীপুর এলাকাটি শিল্প এলাকা হওয়ায় এখানে বড় সমস্যা কারখানার ডাস্ট। বেশিরভাগ কারখানা থেকে নির্গত ডাস্টের কারণে অনেকের শ্বাসজনিত সমস্যা হয়।

সিটির বর্তমান সমস্যা ও প্রত্যাশার বিষয়ে গাজীপুর নাগরিক অধিকারের সভাপতি এডভোকেট জালাল উদ্দিন বলেন, গাজীপুরে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, যানজট, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মাদক-সন্ত্রাস ও বায়ু দূষণ। পাশাপাশি হকারমুক্ত ফুটপাত জনমানুষের দাবি। আগামীতে যারাই নির্বাচিত হবেন, তাদের এ সমস্যাগুলো সমাধানের পথ বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী নগর ব্যবস্থাপনার কাজগুলো এগিয়ে নিতে হবে। এছাড়া গাজীপুরকে গ্রিন সিটিতে রূপান্তরিত করতে একটি পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) সময়ের দাবি। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে গাজীপুর একটি আধুনিক গ্রিন সিটিতে পরিণত হবে বলে মনে করি।

গাজীপুর জেলা টিআইবির সদস্য অধ্যাপক মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, একটি শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ও নিরাপদ বাসযোগ্য শহর চাই। আমারা যেন সুন্দরভাবে নগরীতে বসবাস করতে পারি। এটাই নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা।

এদিকে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আজমত উল্লা খান ও জায়েদা খাতুন। দুজনেই নির্বাচিত হলে নাগরিক সুবিধা আরো বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এছাড়া নগরীর প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি নদী, পুকুর, জলাশয়, মাঠ, পার্ক নির্মাণে জোর দেবেন বলেও জানান। এ বিষয়ে আজমত উল্লা খান বলেন, পুরো সিটি করপোরেশন ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে কাজের ফলে গাজীপুর নোংরা শহরে পরিণত হয়েছে। আমি বিজয়ী হলে এসব সমস্যার সমাধান করে গাজীপুরকে একটি আধুনিক, পরিকল্পিত, স্মার্ট ও শিল্পবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলব। অন্যদিকে জায়েদা খাতুন বলেন, আমার ছেলে জাহাঙ্গীর এই নগরকে আধুনিক ও গ্রিন সিটি করার লক্ষ্যে যে কাজ করেছে, আমাকে নির্বাচিত করলে ছেলের অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার মধ্যদিয়ে এই নগরকে একটি বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলব।

মে ২৩, ২০২৩ at ১০:২৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর