সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চড়েছে পেঁয়াজের বাজার

রমজানে দেশের বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ টাকা। ঈদে দাম ওঠে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এরপর থেকেই ক্রমাগত চড়তে শুরু করে পেঁয়াজ। এখন ভরা মৌসুমেই প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। সংশ্লিষ্টদের মতে- উৎপাদন ঘাটতি, কৃষকদের ধীরে চলো নীতি, হাতবদলের কারণে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানি বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। গত দুই সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা।

এমন পরিস্থিতিতে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয়া হবে বলে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও গতকাল রবিবার জানিয়েছেন, মৌসুম শেষ না হতেই তেতে ওঠা পেঁয়াজের বাজারের পেছনে সিন্ডিকেট জড়িত। ‘ঠাণ্ডা করতে’ আমদানির বিকল্প নেই। আমদানির পর বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে বলে আশা করেন তিনি। এদিকে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আরো দুই-তিন দিন বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পেঁয়াজের উৎপাদন গতবারের তুলনায় দুই লাখ টনের মতো কম হয়েছে। বছরে ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৪০ লাখ টনের মতো। চাষিরা এবার ভুট্টা ও সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। সে কারণে উৎপাদন কিছুটা কমে গেছে। এদিকে দাম ৬০ টাকা হয়ে যাওয়ার পর গত ১০ মে প্রথমবারের মতো পেঁয়াজ আমদানির কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। সাংবাদিকদের সেদিন তিনি দাম না কমলে আমদানির অনুমতি দেয়ার কথা জানান। এরপর সীমিত পর্যায়ে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারকে গত ১৪ মে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বৃষ্টি হলে বা আমদানি বন্ধ হলে দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। আবার আমদানি শুরু হলে দাম কমে যায়। এর পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল বলেছেন, আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফার আশায় অনেকে পেঁয়াজ মজুত রেখে সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কয়েক দিনের ব্যবধানে বেড়েছে। বর্তমান বাজার বিবেচনায় আমরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। ইমপোর্ট পারমিট বা আইপি যেহেতু কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে তারা এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমাদের জানিয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশের কৃষকরা যাতে পেঁয়াজের ন্যায্য মূল্য পান সেজন্য মূলত ইমপোর্ট পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন যেহেতু ভোক্তাদের বাজারে পেঁয়াজ কিনতি হিমশিম খেতে হচ্ছে, তাই আমদানি করা ছাড়া উপায় নেই। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি কোনো সমস্যা নয় বলে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে সমস্যা হলো- আইপি (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) না দেয়া। আমদানির অনুমতি নিলে, এটা ভারত থেকে আসে। সম্প্রতি ভারত থেকে আমরা ডলারে আমদানি করছি না। টাকা ও রুপিতে আমদানি করছি। তাই ডলারের দামের সঙ্গে আমাদের আমদানিতে সমস্যা নেই।

ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বাজার মনিটরিংয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে। আমি আবারো এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বসব। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম ৭৮ শতাংশ বেশি। আগামী বর্ষা মৌসুম ও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে পেঁয়াজের বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ভোক্তাসাধারণ। টিসিবির তথ্যমতে, দেড় মাস আগে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০-৪০ টাকা। তবে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। ফলে দেড় মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৯৩ শতাংশ।

দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। চলতি বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১০ থেকে ১২ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। সে হিসেবে প্রকৃত উৎপাদন দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৪ লাখ টন, যা চাহিদার তুলনায় কম। কিন্তু দেশে বছরের মাঝামাঝি এ সময়ে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। গত সপ্তাহে সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়ে করণীয় নির্ধারণসংক্রান্ত সভায় কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার জানিয়েছেন, এ বছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। আর বর্তমানে মজুত আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। উৎপাদন ও মজুত বিবেচনায় দেশে এ মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষকদের হিসাবে চলতি বছর পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২৪-২৫ টাকা। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কৃষককে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয় ন্যূনতম ৩০ টাকায়। তবে মৌসুম শুরুর পর থেকে গত এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ১৭-১৯ টাকা কেজিতে। ক্রমাগত লোকসান দিয়ে কৃষক এখন সতর্ক হয়ে গেছে। মৌসুম শেষ হতেই তারা লোকসানে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এতে পেঁয়াজের সরবরাহে কিছুটা টানা পড়ে। হঠাৎ সরবরাহ ঘাটতিতে ফরিদপুরসহ পেঁয়াজের প্রধান অঞ্চলগুলোতে দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যদিও এখন আবার কিছুটা কমছে।

তবে ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হাতবদলে অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো। পেঁয়াজের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত তিনবার হাতবদল হয়, যার প্রতিটিতেই ন্যূনতম ১০ টাকা করে দাম বাড়ে।

ফরিদপুরের কয়েকটি পেঁয়াজের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের পর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। সপ্তাহখানেক আগেও পেঁয়াজের দাম বেড়ে ২০০০-২১০০ টাকা মণ (৪১ কেজি) বা ৪৯-৫২ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল। তবে বর্তমানে ১৭০০-১৮০০ টাকা মণ বা ৪২-৪৪ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কিছুটা নিম্নমানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২-৩৫ টাকা কেজি।

কৃষকদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার গত বছরের তুলনায় পেঁয়াজের ফলন কিছুটা কম হয়েছে। গত বছরও প্রতি শতকে প্রায় ২ মণ পেঁয়াজ পাওয়া গিয়েছিল। চলতি বছর সেটা এক থেকে দেড় মণে নেমে এসেছে। ফলে সার্বিক উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে পেঁয়াজের অঞ্চলগুলোতে। পেঁয়াজের মৌসুমে বৃষ্টি, বিরূপ আবহাওয়া ও আমদানি করা কিছু নিম্নমানের বীজের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে গত বছরের তুলনায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। এটাও পেঁয়াজের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়া কাম্য নয়। অথচ দাম বাড়ানোর পরপর ভারত থেকে কিছু পেঁয়াজ আমদানি শুরু করলেই দেশে পেঁয়াজের দাম কমে যায়। এ বিষয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত আসছে। প্রযুক্তির কল্যাণে ফোনে ও এসএমএসে ভারতে বৃষ্টি ও আমদানি বন্ধের খবরে দ্রুত দাম বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, চলতি বছরে পেঁয়াজ চাষাবাদে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ গত বছর ছিল ২২ টাকা, এবার তা বেড়ে হয়েছে ২৮ টাকা। রোজা পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম ঠিক ছিল। কেজিপ্রতি ৫০ টাকা ছিল যা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই ধরা যায়। সাধারণত পেঁয়াজ ওঠে মার্চ-এপ্রিল মাসে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে এমন দাম বাড়া অস্বাভাবিক। তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন, করপোরেট লোকজন সিন্ডিকেট করছে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ লোক। পাবনা-ফরিদপুর অঞ্চলে হাজার হাজার কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করছে। যখনই খবর পাচ্ছে ভারতে বৃষ্টি হয়েছে, তখনই দাম বেড়ে যাচ্ছে। যখন ভারত রপ্তানি বন্ধ করছে তখন দাম বেড়ে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ক্রেতাদেরও সতর্ক হতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কাজ করছি। তবে এর আগে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করছে।

মে ২২, ২০২৩ at ১০:২৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর