ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথের প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো

ছবি- সংগৃহীত।

কক্সবাজার হয়ে ডুলাহাজারি থেকে ঘুমধুম রেল সংযোগ সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ববাহী অবকাঠামো প্রকল্প। এই প্রকল্প সম্পন্নের মাধ্যমে এ বছরই ঢাকা থেকে কক্সবাজার সরাসরি রেল যোগাযোগ শুরু করতে চায় সরকার।

এ পথে রেল চলাচল শুরুর পরেও কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে পুরো সুবিধা পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হবে জনসাধারণকে।

এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু নির্মাণ, চট্টগ্রামের ষোলশহর থেকে দোহাজারী রেলপথের সংস্কার এবং ফৌজদারহাট থেকে ষোলশহর পর্যন্ত বাইপাস রেলসড়ক নির্মাণ।

উল্লিখিত তিন চ্যালেঞ্জের কোনো কার্যকর সমাধান দিতে পারেনি রেলওয়ে। তাই অংশীজনেরা মনে করেন, এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি রেলপথের সম্পূর্ণ সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন না যাত্রীরা। এই রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে রয়েছে ৩৯টি সেতু এবং ২৪২টি কালভার্ট। বন্য হাতি চলাচলের জন্য বানানো হচ্ছে আন্ডারপাস এবং ওভারপাস।

রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু নির্মাণে কমপক্ষে ৭-৮ বছর সময় প্রয়োজন। অর্থাৎ রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও শতবর্ষী সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই চলতে হবে ট্রেনগুলোকে।

তবে সেতুটি যাতে বড় ট্রেনের ভার সইতে পারে সেজন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বুয়েটের সহায়তায় এটিকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংস্কারকাজে ব্যয় হবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

এদিকে, রেলওয়ে সচিব হুমায়ুন কবির সম্প্রতি জানান, আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে কাজ শেষ হলে এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর জুনে শুরু হতে যাওয়া কালুরঘাট ব্রিজের নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লাগবে ছয় মাস।

গত ৬ মে চট্টগ্রামে গিয়ে রেল সচিব বলেন, কক্সবাজারগামী দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য পুরনো রেলওয়ে সেতুটির সংস্কার করা হবে। সেখানে একটি নতুন সেতুও নির্মাণ করা হবে যার নকশা ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সম্প্রতি রেল সচিব মো. হুমায়ুন কবির বলেন, “সব প্রস্তুতি শেষে শিগগিরই নতুন রেলসেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে। ২০২৮ সাল নাগাদ এ সেতুর কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।”

ঢাকা-কক্সবাজার রেল যোগাযোগের জন্য রেলওয়ে আরও কয়েকটি বিকল্প ভেবে রেখেছে। কারণ এই রেলপথ চালু হলে একই সঙ্গে পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। তবে, এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ সুফল পেতে অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে।

সেতু নির্মাণ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা

ঢাকা থেকে কক্সবাজারে রেল সংযোগের অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা কালুরঘাট সেতু। প্রায় শতবর্ষী এই সেতু দিয়ে ভারি লোকোমোটিভ ও কোচ ট্রেনের চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কর্ণফুলী নদীর ওপর এই সেতুটি নির্মাণ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।

দোহাজারী থেকে ঘুমধুম রেলপথের নির্মাণকাজ শুরুর পর ২০১৫ সালে কর্ণফুলীতে নতুন রেলসেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে। সেতু নির্মাণের সেই উদ্যোগ এখনো থেমেই আছে।

কয়েক বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় সেখানে একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও উচ্চতা কম হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাতে বাধ সাধে বিআইডব্লিউটিএ। আবার স্থানীয়দেরও দাবি ছিল রেল ও সড়ক উভয় সেতু নির্মাণের।

রেলওয়ে নতুন করে সেখানে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। বিষয়টি এখন দাতা সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায়।

রেললাইনের দুর্দশা

বর্তমান অবস্থায় চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারীর রেললাইন দিয়ে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল করা দুষ্কর। সিঙ্গেল-লাইন মিটার গেজ এই রেল সড়ক ২০১৮ সালে সংস্কার করা হলেও এর ওপর দিয়ে গড়ে ঘণ্টায় ২০-২৫ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব না।

রেলপথে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারীর দূরত্ব ৪৭.০৪ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে ষোলশহর পর্যন্ত ট্রেন ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা থাকলেও বর্তমানে চালানো হয় ২৫-৩০ কিলোমিটার/ঘণ্টায়।

ষোলশহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগে চলার কথা থাকলেও সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার/ঘণ্টায় চালানো হয় রেলগাড়ি। এই ধীরগতির সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ রেলওয়ে ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথের সংস্কারকাজ শুরু করেছে নিজস্ব অর্থায়নে।

বাইপাস

ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি রেল সংযোগের আরেক অন্তরায় চট্টগ্রাম রেল স্টেশন।

বর্তমান রেলপথের ধরন মাথায় রেখে রেল কর্তৃপক্ষ চায় ফৌজদারহাট থেকে একটি বাইপাস রুট নির্মাণ করতে। যাতে ঢাকা থেকে আসা ট্রেনগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চলাচল করতে পারে। এমনটা হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেন যাত্রায় বর্তমানে অনুমিত সময়ের চেয়ে দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লাগবে।

যদিও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে কোনো কর্মযজ্ঞ চোখে পড়েনি।

কালুরঘাট ব্রিজের সংস্কার

রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, এ বছরের সেপ্টেম্বরেই ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলবে।

মঙ্গলবার কক্সবাজারে স্টেশন চত্বর পরিদর্শনের সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এখন পর্যন্ত রেল প্রকল্পের ৮৪% কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজও দ্রুতই শেষ হবে।”

তিনি বলেন, “সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া দশটি প্রকল্পের মধ্যে দুটি বর্তমানে রেলওয়ে খাতের অন্তর্ভুক্ত। যার প্রথমটি হলো পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প এবং দ্বিতীয়টি দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন রেললাইন নির্মাণ।”

কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজে সহায়তার জন্য সরকার শিগগিরই ফেরি সার্ভিস চালু করতে যাচ্ছে। সামনের মাসেই ফেরি সার্ভিস শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। সংস্কার কাজের বড় অংশ শেষ হতে যাচ্ছে তিন মাসের মধ্যেই।

এ কারণেই চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল তিন মাস বন্ধ থাকবে। সংস্কারের কাজ শেষ হলে এই পথে ট্রেনের গতি বেড়ে দাঁড়াবে ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার।

বুয়েটের পরামর্শক দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ব্রিজে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এ কাজে ঠিকাদার নিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২০ জুন থেকে এ সংস্কার কাজ শুরু হবে। প্রাথমিক কাজ সেপ্টেম্বর নাগাদ শেষ হবে বলে আশা রেলওয়ে কর্মকর্তাদের।

৭০০ গজ দীর্ঘ কালুরঘাট ব্রিজ নির্মাণ করা হয় ১৯৩০ নালে। জীর্ণদশায় পতিত এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন একাধিক ট্রেনের পাশাপাশি শত শত যানবাহন চলাচল করে। নিকটবর্তী বোয়ালখালী উপজেলাবাসীর জন্যও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ সেতুটি ব্যবহার করেন।

নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০০৪ এবং ২০১২ সালে দুই দফায় সেতুটি বন্ধ করে দিয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষ।

মে  ১৯, ২০২৩ at ১৭:২২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর