জাবিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তথ্য জালিয়াতি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত তিনজনের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে আবেদনপত্রে উল্লেখিত ফলাফল লুকোচুরি ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্বে আবেদন করার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এছাড়া অধিক যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। বিভাগের শিক্ষকদের দাবি, বিভাগের সভাপতি ও প্রভাবশালী শিক্ষকদের পূর্ব নির্ধারিত প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই তথ্য জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটেছে।

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ১২ মার্চ ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক পদের নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইতিহাস বিভাগের ৩৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শামসুদ্দোহা মনি, ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. বিপ্লব হোসাইন ও ৪২তম ব্যাচের শারমিন সুলতানাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। তবে এরপরই বিভাগের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চরম বিতর্ক ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদনপত্রে শামসুদ্দোহা মনি স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশনা ছিল বলে জানা গেছে। তবে বিভাগ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শামসুদ্দোহা মনি ৩.৫০ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতকে পঞ্চম ও ৩.৫০ সিজিপিএ স্নাতকোত্তরে যৌথভাবে নবম স্থানে রয়েছেন। অন্যদিকে ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শেষ সময় ছিলো ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি। তবে বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, একই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি শারমিন সুলতানার স্নাতকোত্তরের ফলাফল প্রকাশিত হয়। তবুও তিনি আবেদন করেছেন এবং সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

বিভাগের শিক্ষকেরা জানান, সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়োগ কার্ড ইস্যু না করে, শুধু মেসেজ দিয়ে জানানো হয়েছে- যা নিয়োগ বিধিমালার লঙ্গন। অন্যদিকে প্রভাষক পদে আবেদনপত্রে শামসুদ্দোহা মনি স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান উল্লেখ করে মিথ্যা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি নিয়োগ বোর্ডের মৌাখিক পরীক্ষায়ও তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া স্নাতকোত্তরের ফলাফল প্রকাশের পূর্বে আবেদন করার সুযোগ নেই। তাহলে শারমিন সুলতানা কিভাবে আবেদন করলো! আবার সেই আবেদনপত্র নিয়োগবোর্ডেও গেছে- এটা ভাবনার বিষয়।

এ বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক খো. লুৎফুল এলাহী বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য যাদের সুপারিশ করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে, তাদের চেয়ে ভালো ফলাফলধারী অনেক শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলো। তাই অযোগ্য ও ফলাফল জালিয়াতিতে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিতে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের এমন কর্মকান্ডের নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি।’

নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ড সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে কথা বলার দায়িত্ব বোর্ডের সভাপতির। তবে এতটুকু বলতে চাই, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে ‘মৌখিক নির্দেশনা’ ছিলো। তাই পঞ্চম ও নবম স্থান অর্জনকারী কোন শিক্ষার্থী যদি আবেদনপত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান উল্লেখ করেন, তার দায়ভার ওই শিক্ষার্থীকে নিতে হবে।’

নিয়োগ বোর্ডের আরেক সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এদিকে অভিযোগ স্বীকার করে শামসুদ্দোহা মনি বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তিতে ফলাফল সিজিপিএ ৩.৫০ চাওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা মেনে আবেদন করেছি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পজিশন কত ছিলো- তা চাওয়া হয়নি। তবে আমি স্নাতকে তৃতীয় ও স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় পজিশন উল্লেখ করেছি।’

বিভাগ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী আপনার পজিশন যথাক্রমে পঞ্চম ও নবম স্থান, তাহলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান উল্লেখ করতে পারেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তখন ওইভাবে পজিশন হিসাব করিনি। তবে বিভাগের ফলাফলে আমার পজিশন নবম হলেও থিসিস গ্রুপের ফলাফল অনুযায়ী, আমি যৌথভাবে তৃতীয়।’

অন্যদিকে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট দায়ের করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. শামসুজ্জোহা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মোজাহিদুল ইসলাম সেমিনারে আছি বলে ফোন কেটে দেন। তবে এর আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ও ইতিহাস বিভাগের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।’

নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত রয়েছি। তবে যেহেতু বিষয়টি বিচারাধীনে, সেহেতু এ বিষয়ে আপাতত মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’

মে  ১৭, ২০২৩ at ১৬:২২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/নাছি/ইর