চৌগাছায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে রোজাদার শিক্ষার্থীদের মারপিটের অভিযোগ প্রমাণিত

যশোরের চৌগাছায় প্রধান শিক্ষক কর্তৃক পঞ্চম শ্রেণির রোজাদার শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষা অফিসের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। তবে তদন্তের ৪০ দিন পার হলেও ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। উল্টো ওই প্রধান শিক্ষক বিভিন্নভাবে অভিযোগকারীকে চাপ প্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল (রোজার মাসে) স্কুল চলাকালীন সময়ে চৌগাছা শহরের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন বিদ্যালয়ের চামেলী শাখায় ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানের সময় ক্লাসের সকল (রোজাদারসহ) শিশু শিক্ষার্থীকে লাঠি ও ডাস্টার দিয়ে মারপিট করেন। এতে ওই শিক্ষার্থীদের একজনের হাতের একাংশে ফোলা দাগের সৃষ্টি হয় এবং রক্ত জমাট বেঁধে যায়। বিষয়টি ওই শিক্ষার্থী বাড়িতে গিয়ে তার মাকে জানালে পরদিন ৫ এপ্রিল ওই শিক্ষার্থীর মা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন।

অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার সন্তানসহ ওই শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করেছেন। এর আগেও তিনি বহুবার বেত্রাঘাত করেছেন। তিনি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বড় বেত নিয়ে চলাফেরা করেন এবং শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। তিনি অভিভাবকদের মূল্যায়ণ করেন না, মুখে যা আসে তাই বলেন। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করেন। প্রধান শিক্ষককের পাঠদান ত্রুটিপূর্ণ। বিদ্যালয়ের সার্বিক দিকে নজর দেন না। বিদ্যালয়টি খুবই অপরিচ্ছন্ন। ওয়াশরুমগুলো ব্যবহারের অনুপযুক্ত। বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা নেই। বিদ্যালয়ের দফতরি দিয়ে অতি নিম্ন মানের খাবারের দোকান চালানো হয়। আবেদনে এসব বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে ইউএনওর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

ওই অভিভাবকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (টিও) মোস্তাফিজুর রহমানকে জরুরি ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেন। এর প্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল উপজেলা শিক্ষা অফিসের তিনজন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার নিছার আলী, হায়দার আলী এবং সাইফুল ইসলাম সরেজমিনে তদন্ত করেন। তদন্তে প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

গত ২ মে তিন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অভিযোগকারীর অভিযোগ, শিক্ষার্থী ও প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য পর্যালোচনা ও সরেজমিন তদন্তের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়াও বিদ্যালয় কক্ষ, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও ওয়াশব্লক অপরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে যা সঠিক পরিবেশে পাঠদান বাধাগ্রস্থ হয় বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ মনে করেন। এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হলো।’ তদন্তে তারা উল্লেখ করেন, ‘শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে ওই শাখায় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ৮ থেকে ৯ জন শিক্ষার্থী উঠে দাড়িয়ে তাদেরকে লাঠি দ্বারা আঘাত করার কথা জানায়। তারা আরো জানায় প্রধান শিক্ষক প্রায়ই তাদেরকে লাঠি ও ডাস্টার দ্বারা এবং বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করেন।’

৩ মে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্ত রিপোর্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে জমা দেন। ৪, ৫ ও ৬ মে অফিস ছুটি থাকায় ৭ মে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস তদন্ত প্রতিবেদন যশোর জেলা প্রশাসক বরাবর অগ্রায়ণ করে। তবে ১৫ মে পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন পাননি বলে জানিয়েছেন যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম। ফলে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। রোজার ছুটির পর থেকে ওই প্রধান শিক্ষক নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন ও ক্লাস নিচ্ছেন। ফলে অভিযোগকারী ও স্বাক্ষী দেয়া শিক্ষার্থীরা ভয়ের মধ্যে আছে বলে জানিয়েছেন তাদের অভিভাবকরা। তারা জানান, অভিযোগ করে ও স্বাক্ষী দিয়ে এখন তারাও বিব্রত হচ্ছেন। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন বিভিন্নভাবে অভিযোগকারীর পরিবারকে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে চাপ দিচ্ছেন। রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে মোবাইলে চাপ দেয়াসহ তিনি নিজে বারবার সাথে ৮/১০ জন করে প্রধান শিক্ষক নিয়ে অভিযোগকারীর বাড়ি, উপজেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে ধর্ণা দিচ্ছেন। এমনকি ডিপিও অফিসেও তদবীর করছেন যেন শাস্তি না হয়। এমনকি ১৫ মে সোমবারও অভিযোগকারী পরিবারের একজন অভিভাবককে তিনি অভিযোগ প্রত্যাহার করানোর জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে যেতে বাধ্য করেন। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্পষ্ট জানিয়ে দেন তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

তবে প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন শিক্ষার্থীদের মারপিটসহ তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি ওই শিক্ষার্থীকে মারপিট করিনি। শুধু লাঠি ঘোরাতে গিয়ে একটু লেগেছিলো।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তদন্তে মারপিটসহ সকল অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আমরা রিপোর্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্তে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

তবে যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, এখনো (সোমবার দুপুর) ফাইলটি আমার কাছে আসেনি। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মে  ১৫, ২০২৩ at ২১:৩৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর