যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক বেশে এরা কারা!

ছবি- সংগৃহীত।

রোববার দুপুর ২টা ৪৫ মিনিট। সাদা অ্যাপ্রোন পরা কয়েকজন নারী দলবদ্ধভাবে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে যান। তাদের প্রবেশের পর রোগীর স্বজনরা চিকিৎসক ভেবে নড়েচড়ে বসেন। চিকিৎসক বেশে তারা সিভিডিতে (ব্রেইন স্ট্রোক) আক্রান্ত রোগীদের কাছে যান। এরপর নতুন ভর্তি হওয়া প্রতি রোগীকে ৩শ’ টাকার বিনিময়ে ফিজিওথেরাপি (শারীরিক চিকিৎসা) দেয়া শুরু করেন। তারা দল বেধে হাসপাতালে প্রবেশের আগে ওই চক্রের সদস্যরা চিকিৎসাধীন রোগীদের মাথার কাছে ফিজিওথেরাপি সেন্টারের পরিচিতি কার্ড রেখে আসেন। যারা কার্ড দিতে গিয়েছিল তারাও ছিল সাদা অ্যাপ্রোন পরা।

কার্ড দিয়ে স্বজনদের বলা হয় রোগীর কোনো সমস্যা হলেই কার্ডের নম্বরে ফোন করবেন। সহজ সরল মানুষেরা চিকিৎসক মনে করে প্রায় তাদের ডেকে নেন। সাদা অ্যাপ্রোন পরে ফিজিওথেরাপি চক্রের সদস্যদের হাসপাতালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও তারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি এই হাসপাতালকে ঘিরে ফিজিওথেরাপি ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। ফিজিওথেরাপিস্ট ছাড়াই একটি চক্র নামমাত্র ফিজিওথেরাপি সেন্টার খুলে ধান্দাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। চক্রের প্রায় সব সদস্য নারী। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মেনে সেবা ফিজিওথেরাপি সেন্টার ও সোনালী ফিজিওথেরাপি সেন্টারের সদস্যরা গায়ে অ্যাপ্রন পরে চিকিৎসকের বেশে ওয়ার্ডে ওয়োর্ডে অবাধে প্রবেশ করছেন। প্রথম দেখাতে তাদেরকে যে কোন রোগীর স্বজন চিকিৎসক ভেবে নেন। রোগীর ফিজিওথেরাপির নামে তারা স্বজনদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা লুফে নিচ্ছেন।

আরো পড়ুন :
> যবিপ্রবির টিএসসি’র দায়িত্ব পেলেন ড. মিজানুর
> কেশবপুরে দুটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ৩জন নিহত

পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন সঞ্চিতা রানী জানান, রোববার দুপুরে গায়ে চিকিৎসকের সাদা অ্যাপ্রোন পরা ও গলায় কার্ড ঝুলানো তিন মহিলা আসে। রোগী নতুন ভর্তি হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন। এরপর ৩শ’ টাকা নিয়ে ফিজিওথেরাপি দেন। সঞ্চিতা রানী আরও জানান, প্রথমে তাদেরকে তিনি চিকিৎসক ভেবেছিলেন। পরে বুঝতে পারেন ফিজিওথেরাপি সেন্টারের লোক।

হাসপাতালের পুরুষ- মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড ও পুরুষ-মহিলা পেইং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় রোগীর মাথার কাছে বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি সেন্টারের ভিজিডিং কার্ড রয়েছে।

জানতে চাইলে পুরুষ পেইং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন রাসেল হোসেন জানান, সাদা অ্যাপ্রর পড়া এক নারী কার্ড রেখে গেছেন। দুপুর দুই টার পর রোগীর কোন সমস্যা হলে কার্ডের নম্বরে কল করতে বলেছেন।

সূত্র জানায়, ব্যবসার স্বার্থে ফিজিওথেরাপি সেন্টারের নারীরা চিকিৎসকের মতো সাদা অ্যাপ্রোন পরে রোগীর কাছে যান। তারা কেউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্ট না। অথচ তারা ফিজিওথেরাপিস্ট সেজে রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। অথচ ফিজিওথেরাপি মানে কি সেটাই জানেন না অ্যাপ্রন পরা চক্রের অনেক সদস্য। সূত্র আরও জানায়, তাদের ব্যবসা বাড়াতে হাসপাতালের ওয়ার্ডে দায়িত্বরত কর্মচারীদের (ওয়ার্ডবয়/আয়া) সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সিভিডি রোগী ভর্তি হলে তাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া হয়। বিনিময়ে কর্মচারীরা তাদের কাছ থেকে কমিশন পেয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনিয়র একজন সেবিকা জানান, ফিজিওথেরাপি সেন্টারের ‘ওরা’ যখন গায়ে অ্যাপ্রন পরে দলবেধে ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন তখন নিজেদের খুব অসহায় মনে হয়। সহজ সরল মানুষ তাদেরকে চিকিৎসক ভেবে রোগের বর্ণনা করেন। ফিজিওথেরাপির নামে প্রতি রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ৩শ’ টাকা আদায় করা হয়।

মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, ফিজিও (শারীরিক) এবং থেরাপি (চিকিৎসা) শব্দ দুটি মিলে হয় ফিজিওথেরাপি বা শারীরিক চিকিৎসা। ফিজিওথেরাপি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অন্যতম এবং একটি অপরিহার্য শাখা। শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। বিশেষ করে বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা থেকে যেসব রোগের সৃষ্টি হয়, তার পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের উপায় ফিজিওথেরাপি। একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ফিজিওথেরাপি, যেখানে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর সব কথা শুনে-বুঝে, রোগীকে ভালোভাবে দেখে এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর সঠিক রোগ, আঘাত বা অঙ্গ বিকৃতির ধরন নির্ণয় করে রোগীকে বিভিন্ন ধরনের ফিজিক্যাল মেথড যেমন-ম্যানুয়াল টেকনিক, তাপ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন। অন্যথায় রোগীর আরও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তিনি আরও জানান, সরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ দেয়া হলে রোগীদের অনেক সুবিধা হতো।

এই বিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আব্দুস সামাদ জানান, ফিজিওথেরাপি সেন্টারের সাথে সংশ্লিষ্টদের গায়ে চিকিৎসকের অ্যাপ্রন পরে হাসপাতালে যাওয়া পুরোপুরি নিষেধ। কারণ এতে রোগী ও স্বজনরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। তিনি আরও জানান, তারা সাধারণ পোশাক পরে দুপুর ৩ টার পর ওয়ার্ডে যেতে পারবেন বলে অনুমতি দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মানলে তাদের হাসপাতালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।

মে  ০১, ২০২৩ at ২১:১৪:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর