সমুদ্রে ডাকাতি করতে গিয়ে খুনের শিকার সেই ১০ জন

ছবি- সংগৃহীত।

কক্সবাজারের গভীর সমুদ্রে জেলের বেশে মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি করতে গিয়ে ১০ জন খুন হয়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ জনই পেশাদার জেলে ছিলেন না, তারা আগে কখনো সমুদ্রে মাছও ধরেননি। কক্সবাজারের মহেশখালীর নুরুল কবির তাদের ভাড়া করেছিলেন। এই নুরুল কবির চিহ্নিত জলদস্যু এবং কয়েক বছর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণও করেছিলেন। যে ট্রলার নিয়ে ডাকাতি করতে যাওয়া হয়, সেটির মালিক সামসুল আলমও চিহ্নিত জলদস্যু। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

ওই ট্রলারটি ফিশিং বোট মালিক সমিতির তালিকাভুক্ত নয় এবং সেটির কোনো নামও ছিল না। নিহত ১০ জনের মধ্যে নুরুল কবির ও শামসুল আলমও রয়েছেন।

আরো পড়ুন :
> ছেলে উঠতে না পারায়, ট্রেন থেকে লাফ দিলেন মা
> মহাকাশে আরবের মহাকাশচারীর প্রথম পা

কক্সবাজার জেলা পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জেলেরা নুরুল কবির ও শামসুলের ডাকাত দলকে একযোগে প্রতিরোধ করতে গিয়ে ওই খুনের ঘটনা ঘটে। জেলেরা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হাত-পা বেঁধে ট্রলারের মাছ ও বরফ রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে সেই কক্ষ আটকে ট্রলারটি ডুবিয়ে দিয়েছিল। গত ৯ এপ্রিল ওই ঘটনা ঘটে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার সময় মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে থাকা কামাল হোসেন ওরফে বাইট্ট কামাল ও করিম সিকদার নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে।

১০ জনকে হত্যার পর গভীর সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া ট্রলারটি অন্য একটি মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়েছিল। ওই ট্রলারের জেলেরা রশি দিয়ে ট্রলারটি টেনে মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেলে নিয়ে আসেন। গত রোববার দুপুর দেড়টার দিকে ডুবে যাওয়া ট্রলারটি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক (বিমানবন্দরের পশ্চিমে) চ্যানেলে আনা হলে মৃত ব্যক্তির হাত-পা ভেসে উঠতে দেখা যায়। তাতে ভয় পেয়ে টেনে আনা ট্রলারের জেলেরা পালিয়ে যান। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। তাদের মধ্যে তিনজনের হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। কয়েক জনের শরীরে ছিল জাল প্যাঁচানো। একটি লাশের গলা থেকে মাথা ছিল বিচ্ছিন্ন। আরেকটি লাশের হাত বিচ্ছিন্ন পাওয়া গেছে।

কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশ জানায়, মোটামুটি ১০ জনের পরিচয়ই স্বজনরা শনাক্ত করেছেন। তবে ৬ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। একাধিক দাবিদার থাকায় চারজনের মরদেহ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ১০ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। হত্যাকাণ্ডের রহস্যও মোটামুটি উদ্ঘাটন করা গেছে। এখন জড়িত আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা গেলে সবকিছু পরিষ্কার হবে। পুলিশ সেই চেষ্টা করছে।

পুলিশ সুপার বলেন, মহেশখালীর নুরুল কবির জেলে নন, এমন কয়েকজনকে নিয়ে সমুদ্রে গিয়েছিলেন। শামসুল আলমের ট্রলারটিরও নাম নেই। এ দুজনের বিরুদ্ধেই আগে ডাকাতি ও মাদকসহ নানা মামলা রয়েছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে। অন্য ৮ জনের পূর্বের রেকর্ডও যাচাই করা হচ্ছে। তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এরা কেউই জেলে নন, কখনো মাছ ধরতে সমুদ্রে যাননি। তাহলে নুরুল কবির কেন তাদের ট্রলারে তুললেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হচ্ছে।

জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল অন্য এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ঘটনার সময় গভীর সমুদ্রে থাকা অন্য ট্রলারের জেলেদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এতে মনে হয়েছে, ট্রলারটিতে কোনো নামও ছিল না। ১০ জনের মধ্যে অধিকাংশেরই ছিল কালো গেঞ্জি ও পাফপ্যান্ট পরা। সাধারণত মাছ ধরার ট্রলারের নাম থাকে এবং জেলেদের বেশভূষাও এমন নয়। এসব কারণে জলদস্যুর নৌযান সন্দেহে অন্যান্য মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা একযোগে সেটি ঘেরাও করে হামলা চালিয়েছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, এখন এই হামলা পরিকল্পিত বা নুরুল কবির ও শামসুল আলমের সঙ্গে অন্য কোনো ট্রলারের পূর্ব শত্রুতা, নাকি নিছকই ডাকাত প্রতিরোধ করতে গিয়ে হয়েছে–সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।

পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, ট্রলার মালিক সামশুল আলমের সঙ্গে মহেশখালীর আরেক ট্রলার মালিক বাইট্যা কামাল ও তার ভাই আনোয়ার হোসেনের বিরোধ চলছিল। দুপক্ষের বিরুদ্ধে সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালানো এবং জলদস্যুদের সঙ্গে সখ্য থাকারও অভিযোগ রয়েছে।

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে : ১০ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় নিহত শামসুল আলমের স্ত্রী রোকিয়া আকতার বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে একটি মামলা করেন। এজাহারে কামাল হোসেন ওরফে বাইট্যা কামালকে, তার ভাই আনোয়ার হোসেনকে, বাবুল মাঝি ওরফে শুক্কুর কোম্পানি এবং করিম সিকদারসহ চার জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে বাইট্যা কামাল ও করিম সিকদারকে গতকাল পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, শামসুল আলম ১০ থেকে ১২ জন মাঝি-মাল্লাসহ গত ৭ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে নিজের ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে নামেন। পরের দিন (৮ এপ্রিল) সকাল ৮টার দিকে শামসুল তার স্ত্রীর (বাদির) মোবাইল ফোনে কল করে জানান, জালে অনেক মাছ ধরা পড়েছে। এর পর থেকে আর স্বামীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে পারেননি।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শামসুল আলম সাগরে মাছ ধরতে গেলে আসামিরা বিভিন্ন সময় মাছ ধরতে বাধা ও হত্যার হুমকি দিতেন। পূর্বশত্রুতার জেরে তারা ৫০ থেকে ৬০ জন মিলে ট্রলারে থাকা মাছ ও জাল লুট করেন। এতে বাধা দিতে গেলে শামসুলসহ অন্যদের গলায় দড়ি পেঁচিয়ে, হাত-পা দড়ি ও জাল দিয়ে বেঁধে ট্রলারের মাছ রাখার কক্ষে আটকে রাখা হয়। এরপর কাঠ দিয়ে পেরেক মেরে কক্ষ আটকে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারের তলা ফুটা করে দেয় আসামিরা। এতে ট্রলারটি পানিতে ডুবে যায়।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দুজনকে আজ বুধবার সকালে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করা হবে।

এপ্রিল ৩০, ২০২৩ at ১৩:০২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর