দৌলতপুরের দুর্গম চিলমারী ইউনিয়ন অশান্ত, আ.লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ১৪

দুই পক্ষের সহিংসতার ঘটনায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী ইউনিয়ন হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শেলী দেওয়ান ও তার ভাইসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে চরাঞ্চলের দুর্গম ওই ইউনিয়নটিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

দৌলতপুর উপজেলার পদ্মার ওপারের দুর্গম ইউনিয়ন চিলমারীতে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শিকদার গ্রুপ, খাঁ গ্রুপ ও মণ্ডল গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। সম্প্রতি এলাকার একটি রাস্তা নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ নিয়ে সেখানে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই ইস্যুতে শিকদার ও খাঁ গ্রুপ এক হয়ে যায়। প্রতিপক্ষ মণ্ডল গ্রুপও শক্ত অবস্থান নেয় । দুই পক্ষের মধ্যে চরম উত্তেজনার একপর্যায়ে সহিংসতা দেখা দয়ে। এর জের ধরে পেট্রোল ঢেলে প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুর থেকে শুরু করে বিকাল পর্যন্ত উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের বাজারপাড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে। এ সময় মণ্ডল গ্রুপের লোকজনের ওপর হামলা ও বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের লোকজন। এতে ৫ জন গুরুতর দগ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।

এ সময় মণ্ডল গ্রুপের মোজাম্মেল হোসেন, ইকবাল মাস্টার, রানা আহম্মেদ, ইকলাস হোসেন ও জহুরুল মণ্ডলের বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়া হয়। এতে বেশ কয়েকজন দগ্ধ হন, অন্যদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়। খবর পেয়ে দৌলতপুর থানার ওসি মজিবুর রহমান পর্যাপ্ত ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।

গুরুতর আহত ৫ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চিলমারী গ্রামের দবির মণ্ডলের ছেলে দিনু মণ্ডল (৬৫), তার ছেলে ফারুক মণ্ডল (২২) ও তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আকতার মণ্ডলকে (৪০) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। আব্দুর রহমান কাজীর ছেলে সাইদুল কাজী (৩০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বিশু মণ্ডলের ছেলে ফজলু ডাক্তার ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জখম ও দগ্ধ অন্তত ১২ জনকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এই সহিংস ঘটনায় ফের নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে উপজেলার বিচ্ছিন্নপ্রায় দুর্গম ইউনিয়নটি। বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। পুনরায় সহিংসতা এড়াতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

দৌলতপুর উপজেলার দুর্গম ইউনিয়ন চিলমারীতে প্রতিপক্ষের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ির সামনে এক নারীর কান্না ।

এ ঘটনায় শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে মোজাম মণ্ডল বাদী হয়ে ৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসহ ১২০ জনকে আসামি করে দৌলতপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।

ওই রাতেই এ মামলার প্রধান আসামি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শেলী দেওয়ান ও তার ছোট ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল দেওয়ানসহ ১৪ জন র‍্যাব ও পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার শেলী দেওয়ান ও তোফায়েল দেওয়ান দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মৃত আব্দুল জব্বার দেওয়ানের ছেলে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকা থেকে শেলী দেওয়ানকে এবং রাতে চিলমারীর নিজ এলাকা থেকে তোফায়েল দেওয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন র‌্যাব-১২ কুষ্টিয়া ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার মো. তৌহিদুল মবিন খান।

মবিন খান জানান, চিলমারী গ্রামে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার’ ঘটনায় এজাহারনামীয় এক নম্বর আসামি শেলী দেওয়ান ও তিন নম্বর আসামি তোফায়েল দেওয়ানকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, খাঁ ও শিকদার গ্রুপের সঙ্গে মণ্ডল গ্রুপের বিরোধ চলছিল। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত খা ও শিকদার গ্রুপের লোকজন একত্রিত হয়ে দফায় দফায় মণ্ডল গ্রুপের লোকজনের বাড়িতে হামলা করে। এ সময় পিস্তল, ককটেল, পেট্রোল বোমা ও রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের লোকজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন আহত হয়েছেন।

দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মজিবুর রহমান শনিবার দুপুরে জানান, পূর্ব বিরোধের জেরে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এ পর্যন্ত এজাহারনামীয় ৯ জনসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ ও র‍্যাবের অভিযান চালানো হচ্ছে।

এদিকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম শেলী দেওয়ান ভাইসহ গ্রেপ্তারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এতে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি জানানো হচ্ছে।

এক বিবৃতিতে শেলী দেওয়ানের আরেক ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য, কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মিঠু দেওয়ান বলেন, আমার বাবা মরহুম আব্দুল জব্বার দেওয়ান মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। আমার পুরো পরিবার জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। আমাদের পরিবারের কারো নামে বিগত সময়ে কখনো কোনো ক্রিমিনাল অফেন্সের রেকর্ড নেই। বড় ভাই শেলী দেওয়ান ও ছোট ভাই তোফায়েল দেওয়ানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। আমি এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।

এপ্রিল ২৯, ২০২৩ at ১৩:৩০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/ইর