পুকুর খননের নামে নেতার বালু উত্তোলন: নদী গর্ভে বিলীনের পথে ৩৫ হিন্দু পরিবার

পুকুর খননের অজুহাতে গ্রামের মাঝে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর উপর চলছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন। নদী থেকে বালু উত্তোলনের পর সেই বালু রাখার জন্য নদীর পাশেই ৩ বছরের জন্য লিজ নেয়া হয়েছে অন্যের জমি। গত ২০২১ সাল থেকে তোলা হচ্ছে এই বালু। ৩ বছর গড়িয়ে গেল তবে শেষ হলো না নেতার বালু উত্তোলন। হলো না পুকুর খনন।

দীর্ঘদিন থেকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পৌর এলাকার লালমাটি গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে চলা মহিলা নদীতে এই বালু উত্তোলনের মহোৎসবে মেতে আছেন স্থানীয় সামসুজ্জামান মানিক। তিনি ওই গ্রামের জামায়াত নেতা জহুরুল হকের ছেলে। তিনি নিজেকে আওয়ামীলীগ নেতা বলে দাবি করলেও, ভূক্তভোগী এবং স্থানীয় আওয়ামীলীগ অভিযোগ তিনি এবং তার পরিবার বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। তার বাবা সাবেক জামায়াত নেতা জহুরুল হক মাওলানা নাশকতা ও অর্থআত্মসাৎসহ বেশ কয়েকটি মামলায় সাজা ও গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকায় গত বছর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে দিনাজপুর জেলা কারাগারে কারাবরণ করছে।

এদিকে নদী থেকে টানা বালু উত্তোলনের কারণে ৩৫ টি হিন্দু বসতবাড়ি সহ তাদের আবাদি জমি ও ফলের বাগান নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। গত ফেব্রুয়ারী মাসের ৫ তারিখে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক বরাবর এমন একটি অভিযোগ দেন ভূক্তভোগী ৩ হিন্দু পরিবার। সেই অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক।

অভিযোগে অসহায় হিন্দু পরিবার গুলো দাবি করেন, মানিক ও এতাউল নামের দুজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন আগে নদীর পাড়ে কিছু জমি কিনে নেয়। এরপর তারা ব্যক্তিগত জমিতে পুকুর খননের নামে সেখানে দুটি ভারী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করে। গত বছরের জুলাই মাসে স্থানীয়রা লিখিত অভিযোগ দিলে ওই মাসে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে সেখানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে উপজেলা প্রশাসন। এরপর আবারও গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে বালু উত্তোলন শুরু করে এই নেতা বলে নতুন করে অভিযোগ ভূক্তভোগীদের।

শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পানিতে একটি ড্রেজার মেশিন রাখা আছে। নদীর পাড়েই হিন্দু সম্প্রদায়ের আবাদি জমি ও ফলের বাগান সহ তাদের বসবাসের ঘরবাড়ি। নদীর পাশেই বিশাল একটি জায়গায় কয়েক হাজার ট্রাক বালু স্তুপ করে রাখা আছে। সেখানে বিশেষ যন্ত্র এস্কেভেটরের (ভেকু) সাহায্য ৫ থেকে ৭টি ছোট ছোট ট্রাকে বালু গুলো উঠানো হচ্ছে। এসব ট্রাকে বালু যাচ্ছে আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। বালু বোঝাই এসব ট্রাক গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার ফলে রাস্তায় লালমাটির বালুর সৃষ্টি হচ্ছে। এতে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। এছাড়াও রাস্তার এসব লাল বালু বাতাসে উড়ে রাস্তার পাশের আম ও লিচুর গাছ লাল হয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে আম-লিচুর মুকুল। ফলে লোকসানের শঙ্কায় বাগান মালিকরা।

নদী গর্ভে বিলীন হবার শঙ্কায় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া বিশ্বনাথ রায় বলেন, ‘নদীর পাড়ের কিছু আবাদি জমি ও বসতভিটা ছাড়া আমাদের কিছু নেই। নদীর গভীর থেকে নিয়মিত বালু তোলা হচ্ছে। বর্ষাকালে আমাদের বাড়িঘর সহ সবকিছু নদীতে তলিয়ে যাবে। আমরা একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছি। প্রশাসন এসে বন্ধও করে দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার জোরে মানিক আবারও বালু উত্তোলন শুরু করে। আমাদের শেষ সম্বল ভিটেমাটি রক্ষা করতে আমরা সংখ্যালঘু লোকজন প্রশাসনের সহযোগীতা কামনা করছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘মানিক কোন সময় আওয়ামীলীগ করত না। তাকে কোন দিন দলীয় মিছিল মিটিং এ দেখা যায়নি। তার বাবা জামায়াতের তুখোর নেতা ছিলেন। মামলা থেকে বাঁচতে সে এখন আওয়ামীলীগ সাজার চেষ্টা করছে। আর স্থানীয় কিছু পাতি নেতা ও আওয়ামীলীগে অনুপ্রবেশকারী টাকা খেয়ে মানিককে নেতা বানানোর চেষ্টায় মেতে আছে।’

ঘোড়াঘাট উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বুলাকীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সদের আলী খন্দকার বলেন, ‘আমি মানিককে কোন দিন কোন দলীয় প্রোগামে দেখিনি। আওয়ামীলীগের কোন পদপদবিতেও তিনি নেই।’

অভিযুক্ত সামসুজ্জামান মানিক বলেন, ‘আমি আমার নিজের জমিতে পুকুর খনন করছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে আমি পুকুর খননের লিখিত আদেশ নিয়ে এসেছি। হিন্দু পরিবারের দু’একজন আমাকে নিয়ে চক্রান্ত করছে।’ ঘোড়াঘাট পৌরসভার মেয়র আব্দুস সাত্তার মিলন বলেন, ‘এরআগে আমার কাছে অভিযোগ এসেছিলো। প্রশাসনের সহযোগীতায় বালু উত্তোলন আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নতুন করে অভিযোগ পেলে আবারও ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে ঘোড়াঘাট উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘পুকুর খননের বা শ্রেণী পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটি কেবলমাত্র জেলা প্রশাসক দিতে পারে। তবে এই বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমি জানি না। তিনি যদি অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করে, তবে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’