ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল থেকে গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট উত্তোলনের হিড়িক

৪৫ বছর বয়সি আনোয়ারা বেগম ভুগছেন ডায়াবেটিক রোগে। চেকআপের জন্য নিয়মিত তিনি আসেন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে। তার পেটে গ্যস্ট্রিকের তেমন সমস্য না থাকলেও তিনি নিয়মিত অমিপ্রাজল গ্রুপের গ্যাসের বড়ি নিয়ে সেবন করেন। এই বড়ি তিনি সরকারী ভাবে ফ্রি নিয়ে থাকেন।

আনোয়ারা বেগমের মতো রমেচা খাতুনও নিয়মিত হাসপাতালের গ্যাস্ট্রিকের বড়ি সেবন করেন। আনোয়ারা বা রমেচা বেগমরা জানেন না দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস্ট্রিকের বড়ি সেবনের ভয়বহতা। চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীরা সরকারী হাসপাতালের চেম্বারে এসে নিজের কষ্টের কথা না বলে সরাসরি ডাক্তারদের কাছে গ্যাসের বড়ি চান।

শতকরা ৮০ ভাগ রোগী নিজেরাই গ্যাসের বড়ি চেয়ে নেন। ফলে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠির জীবন হুমকীর মুখে পড়েছে। গ্যাস্ট্রিকের বড়ির এই ভয়ংকর অপব্যবহার কমাতে না পারলে নিয়মিত অমিপ্রাজল সেবনকারীদের স্বাস্থ্য ঝুকির মুখে পড়তে পারে। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল সুত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন আউটডোরে ২০ হাজার এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগ বিতরণ করা হয়।

এই হিসেবে সপ্তহে এক লাখ চল্লিশ হাজার গ্যাসের বড়ি নিচ্ছেন মানুষ। গ্যাসের বড়ির পাশাপাশি প্রতিদিন চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক প্যারাসিটামল দশ হাজার ও ক্যালসিয়াম বড়ি সমপরিমান বিতরণ করা হচ্ছে। সদর হাসপাতালের ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট রুহুল আমিন জানান, দিন যতই যাচ্ছে গ্রহনের প্রবণতা বাড়ছে। তিনি বলেন বছরে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল থেকে ৫৭ লাখ এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগের চাহিদা রয়েছে।

অথচ ২/৩ বছর আগেও মানুষের মাঝে এই প্রবণতা ছিল না। হরিণাকুন্ডুর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. নজরুল ইসলাম জানান, লম্বা সময় ধরে যদি কেউ এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগ গ্রহন করে তাহলে তার হাড় ক্ষয় রোগ হতে পারে। সমাজে কিন্তু হাড় ক্ষয় রোগ এখন বেশি ধরা পড়ছে।

আর এই রোগটি হচ্ছে চল্লিশ বছর পার হলে। তিনি বলেন, বাজারে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধের পরই সর্বোচ্চ বিক্রিত ঔষধ হচ্ছে এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগ। দেদারসে মানুষ বছরের পর বছর এসব ওষুধ খেয়ে আসছে। ফার্মেসি থেকে সহজেই মানুষ এসব কিনতে পারছে প্রেসক্রিপশন ছাড়া। সঠিক রোগ নির্ণয় ছাড়াই মানুষ নিজেরা এসব ঔষধ খেয়ে আসছে।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সাবেক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বর্তমান ঢাকার গ্রীণ লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ফাত্তাহ বলেন, এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগ চিকিৎসক কখন প্রেসক্রাইব করি বা কতদিনের জন্য করা হয় সেটা জানা প্রয়োজন। সাধারণত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে বলে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তা হচ্ছে বুক জ্বালা পোড়া, পেটে ব্যথা, হজম না হওয়া।

গ্যাস নির্গত হওয়া ও ক্ষুধা অনুভূত না হওয়া। এসব লক্ষণ সাধারণত পেপটিক আলসার ডিজিজ, নন আলসার ডিসপেপসিয়া বা গল স্টোন জাতীয় সমস্যার জন্য হয়ে থাকে। তবে বেশীর ভাগই লাইফ স্টাইল সঠিক না হওয়ার কারনেই হয়ে থাকে। যেমন সময়মত আহার না করা, বেশি বেশি পানি পান না করা, তেল, মসলা ও ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার খাওয়া।

রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগের ইতিহাসের পাশাপাশি Endoscopy, USG এসব পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রোগ নির্ণয় হলেই কেবলমাত্র এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগ প্রেসক্রাইব করা উচিত, তাও সর্বোচ্চ ৮ সপ্তাহের জন্য। এর বেশি কোনভাবেই নয়। ডাঃ আব্দুল ফাত্তাহ বলেন, লম্বা সময় ধরে এসব ঔষধ খেলে ডায়রিয়া, বমি ভাব, পেটে ব্যথা হতে পারে। তবে জটিল বা মারাত্মক পার্শপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে আরো বেশি গ্যাস্ট্রিক তৈরি হওয়া।

তিনি বলেন, র্গ্যাস্ট্রিকের বড়ি পাকস্থলিতে সব ধরণের এসিড সিক্রেশন বন্ধ করে দয়। ফলে খাবারের সঙ্গে যে খারাপ জিনিসগুলো প্রবেশ করে তা এসিড সিক্রেশন বন্ধ হয়ে গেলে জীবানু ধ্বংস হয় না। ফলে এসিডের অভাবে আবারো পকস্থলিতে গন্ডগোল বাধতে পারে।

তা হলো Hyper Gastrinemia । চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়ার মত ইনফেকশন হতে পারে অ্যাসিড সিক্রেশন কমে যাওয়ার কারণে। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এসব মিনারেল শরীরে কমে গিয়ে ফ্র্যাকচার পর্যন্ত হতে পারে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক পার্শপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে Parital Cell Hypertrophy হয়ে Gastric Carcinoma বা পাকস্থলীর ক্যান্সার।

বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাঃ সৈয়দ রেজাউল ইসলাম জানান, সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এই গ্যাসের বড়ি সেবনের প্রবণাতা রোধ করা যাবে না। তিনি বলেন, ঝিনাইদহ হাসপাতালে সবচে বেশি গ্যাসের বড়ি নেন মহিলারা। সংসারের কাজের কারণে হয়তো তারা সময় মতো পানি পান করতে পারেন না। ফলে গ্যাস্ট্রিকের প্রথম ধাপে তারা আক্রান্ত হন। নিয়ম মেনে যদি তারা প্রথম ধাপ উতরাতে পারতেন তবে এন্টি আলসারেন্ট ড্রাগ গ্রহন প্রয়োজন হতো না।

আরো পড়ুন:
> হরিণাকুন্ডুতে কৃষক হত্যা মামলায় পিতাপুত্রসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
> মিথ্যা মামলায় জেল খাটলেন রেজওয়ান

মার্চ ০৫, ২০২৩ at ১৮:৪১:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/কালি/সুরা