কুবির শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মচারীরা অভিযোগ সম্পর্কে জানতেন না কিছুই, পাল্টা অভিযোগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পরিষদের ৮ জন ও চতুর্থ শ্রেণী থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত একজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার অভিযোগে বিভিন্ন শাস্তি দিয়েছে সমিতি৷ গত ২৩ জানুয়ারি (সোমবার) তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পরিষদের সভাপতি দিপক চন্দ্র মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক মো: মহসিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ভুক্তভোগীরা শাস্তির বিষয়টি জানতে পারেন। তবে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত তদন্ত কমিটি কবে গঠিত হয়, এবং তদন্ত কমিটির সদস্য কারা এমনকি শাস্তি পাবার পূর্বে অভিযোগ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বলে পাল্টা অভিযোগ করেছে শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মচারীরা।

কর্মচারী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের ১৩ জন সদস্যের মাঝে বিভিন্ন পদে থাকা ৭ জনের সাথে কথা বললে তাদের কেউই গঠিত তদন্ত কমিটি সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য কিংবা কারা কমিটির সদস্য বিষয়টি জানাতে পারেনি। বরং বিষয়টি নিয়ে সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের কথা জানান। তারা বলেন, সভাপতি সাধারণ সম্পাদক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা জানি শাস্তি দিয়েছে। কাকে দায়িত্ব দিয়েছে সেটা তারা বলতে পারবেন।

বহিষ্কারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংগঠনিক সকল কাজে বিশৃঙ্খলা ও মিথ্যা-গুজব ছড়ানো এবং একাধিক অপরাধের সাথে সরাসরি ও প্রত্যক্ষ জড়িত থাকায় সাংগঠনিক অপরাধে দণ্ডিত করে গণিত বিভাগের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ডাটা প্রসেসর (আপগ্রেড) ও কর্মচারী পরিষদের ২০১৮-১৯ কমিটির সহ-সভাপতি এ কে এম কামরুল হাসানের সদস্যপদ বাতিল ও পরিষদের ২ টি নির্বাচনের প্রার্থীতা বাতিল করা হয়।

একই অভিযোগে রসায়ন বিভাগের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট (আপগ্রেড) নাছির উদ্দিন ও বাংলা বিভাগের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ডাটা প্রসেসর (আপগ্রেড) মো. জিয়াউর রহমানের সদস্যপদ স্থগিত ও পরিষদের ১টি নির্বাচনের প্রার্থীতা বাতিল করা হয়।

মার্কেটিং বিভাগের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ডাটা প্রসেসর ও ২০১৮-১৯ কমিটির কার্যকরী সদস্য মো. হাবিবুর রহমান ও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ডাটা প্রসেসর (আপগ্রেড) মো. আবদুল কাদেরের সদস্যপদ বহাল রেখে ১টি নির্বাচনের প্রার্থীতা বাতিল করা হয়।

এছাড়া উল্লিখিত অভিযোগে ইন্ধনকারী হিসেবে অভিযুক্ত ফার্মেসী বিভাগের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট (আপগ্রেড) মো. আবদুল আউয়ালকে সদস্যপদ বাতিল ও অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। এস্টেট শাখার বাগান মালী ও ২০১৮-১৯ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সামছু মিয়াকে ভবিষ্যতে তৃতীয় শ্রেণী কর্মচারী পরিষদের নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং পরিবহন শাখার ড্রাইভার (গ্রেড-২) ও বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. শাহিনুর হোসেন ও রেজিস্ট্রার দপ্তরের ডেসপার্স ক্লার্ক মো. আবুল বাসারকে সাধারণ কর্মচারীদের পক্ষ থেকে তিরস্কার করা হয়।

যদিও কর্মচারী সমিতির গঠনতন্ত্রে সদস্য পদ বাতিলের কারণ হিসেবে বলা হয়, গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কাজ, পরপর ০৩ মাস মাসিক চাঁদা পরিশোধ না করা হলে, চাকুরি থেকে পদত্যাগ করলে, অবসর গ্রহণ করলে, বহিস্কৃত হলে, মৃত্যুবরণ করলে, মানসিক বিকৃতি ঘটলে কিংবা পরিষদের অর্থ ও সম্পত্তি তছরূপ কজরা প্রমাণিত হলে, তাঁর সদস্যপদ বাতিলের কথা বলা হয়।

তবে আলোচিত ৯ সদস্যকে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে উপরের কোন বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু তদন্ত কমিটি কবে এবং কততম সভায় গঠিত হয় সে বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কল রিসিভ করেননি সমিতির সভাপতি দিপক চন্দ্র মজুমদার। অপরদিকে এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারেননি খোদ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহসিন।সাধারণ সম্পাদক মো. মহসিন জানান, ‘আমরা যাই করেছি গঠনতন্ত্র মেনে করেছি। তবে গঠনতন্ত্রের কোন ধারা উপধারা অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন সেটি তাদের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন :
>আকাশ থেকে অজ্ঞাত বস্তু ভূপাতিত করলো যুক্তরাষ্ট্র
>দেশের সব ইউনিয়নে আ. লীগের শান্তি সমাবেশ আজ

আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করলে তিনি জানান, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ সুবিধা আর আমাদের সুযোগ সুবিধা এক নয়। কাজেই তারা কি করবে কিংবা করবেনা সেটি আমরা জানতে চাই না৷
আবার তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য মো. হানিফ যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তবে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী হয়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের অপরাধ তদন্তে কমিটিতে থাকতে পারেন কিনা জানতে চাইলে মহসিন জানান, অবশ্যই পারে। অধ্যাপকের বিরুদ্ধে গঠিত কোন তদন্ত কমিটিতে প্রভাষক যদি থাকতে পারেন তাহলে এখানেও পারে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমিতির এমন পদক্ষেপকে অবান্তর এবং গঠনতন্ত্র বিরোধী বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তবিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ফেডারেশনের নেতারা। বিষয়টিকে ব্যাক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমিতির সভাপতি সরোয়ার মোর্শেদ বলেন, কর্মচারী সমিতি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন না। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন। একইরকমভাবে কোন সদস্যকে তারা বহিষ্কারও করতে পারেন না। এটি নিয়মবহির্ভূত এবং গঠনতন্ত্র বিরোধী। সমিতির কোন সদস্যকে এভাবে বহিষ্কার করা যায়না। এটা নিয়মবহির্ভূত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম হাওলাদার জানান, সমিতির কোন সদস্যকে এভাবে বহিষ্কার করা যায়না। এটা নিয়মবহির্ভূত। একমাত্র রেজিস্ট্রার কোন তদন্ত কমিটি কিংবা শাস্তির পদক্ষেপ নিতে পারেন। সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হয়তো নিজেদের স্বার্থে এমন কাজ করছে।

চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. সুমন জানান, কোন অভিযোগ ব্যাতীত, কোন সাধারণ সভা ব্যাতীত, কোন কারণ দর্শানোর নোটিশ ব্যাতীত সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তি দেবার সুযোগ নেই। এমন কোন ব্যাবস্থা নিতে হলে কোন একজন বাদীর অভিযোগ থাকতে হবে। তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। তার জন্য চিঠি প্রেরণ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এখানে যা হয়েছে সম্পূর্ণ মনগড়া ব্যাক্তিগত আক্রোশের স্বীকার কয়েকজন কর্মচারী।

আন্ত বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার এসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ আমিরুল ইসলাম জানান, প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বস্তর প্রশাসনিক ব্যাক্তবর্গ ব্যাতীত সমিতি থেকে এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন না। এটি বিধি বহির্ভূত।

আন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি মহিউদ্দিন খন্দকার জানান, সদস্য পদ বাতিল করতে হলে সাধারণ সভায় সেটি পাস করিয়ে নিতে হবে। আবার শাস্তি প্রদান করতে হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে তিনবার। মনগড়া সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন সুযোগ নেই।

এদিকে কোন পদ্ধতিতে তদন্ত করা হয়েছে? এবং অভিযুক্তদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অর্থ ও হিসাব দপ্তরের হিসাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন চৌধুরী প্রতিবেদকের সাথে উচ্চবাচ্য করেন এবং সাংবাদিকদের তথ্য দিতে বাধ্য নয় বলে জানান।

আবার সমিতির দপ্তর সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন যিনি গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব, তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কার্যকরী পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি আমাকে দায়িত্ব দেয় তাহলে কি আইনের কোন বাধা আছে! আর এই বিষয়ে কমিটির অন্যান্য সদস্যরা না জানার বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই। যারা বলেছে তদন্ত কমিটির বিষয়ে তারা জানে না আপনি তাদের সাথে আবার কথা বলেন। অতঃপর কথা বলতে অনাগ্রহতা প্রকাশ করে তিনি ফোন কেটে দেন।

জানা যায়, কর্মচারী পরিষদের চলমান কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে ২২ ডিসেম্বর এবং দায়িত্ব গ্রহণ হয় ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারী। তৃতীয় শ্রেণী কর্মচারী পরিষদের গঠনতন্ত্রের ৭ নাম্বার ধারা অনুযায়ী নির্বাচনের তারিখ থেকে দুই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারী (২ বছর হিসেবে) এ কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হবার কথা।

কিন্তু শাস্তি প্রদানের জন্য ডাকযোগে প্রেরিত চিঠিতে তারিখ উল্লেখ ছিল মেয়াদ উত্তীর্ণের শেষদিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারী। এবং শাস্তিপ্রাপ্তরা সেটি গ্রহণ করেন ২৫ জানুয়ারি। ফলে কমিটির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারীতা অভিযোগ তুলেছেন শাস্তিপ্রাপ্তরা।

সদস্য পদ বাতিল হওয়া ২০১৮-১৯ সেশনে সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করা কামরুল হাছান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি এ বছর সভাপতি পদে নির্বাচন করব। এ বিষয়টি সবাই জানে। মূলত আমাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে মনগড়া শাস্তি প্রদান করা হয়েছে৷ আমি এ সিদ্ধান্ত মানি না। তারা নিজেরা কমিটি করেছে নিজেরাই শাস্তি প্রদান করেছে। আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমরা প্রয়োজনে হাইকোর্ট পর্যন্ত যেতে চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, আমি অসুস্থ থাকায় কয়েকদিন অফিসে আসতে পারিনি। তবে বিষয়টি কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অফিসিয়াল কাজে গাফলতি বা অন্য কোন কারনে শাস্তি প্রদান করা হয়নি। তারা তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাজ করেছে।তবে গঠনতন্ত্রে এমন কিছু নেই তবুও কেন শাস্তি এবং সমিতির দপ্তর সম্পাদক তদন্ত কমিটিতে থাকতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ছুটিতে আছি। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে এই মুহুর্তে বেশি কিছু বলতে চাই না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ফেব্রুয়ারি ১১.২০২৩ at ১১:৪৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/তই/এমএইচ