রমজানের ভোগ্যপণ্য সরকারে স্বস্তি, ব্যবসায়ীরা শঙ্কায়

দফায় দফায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে।ছবি- সংগৃহীত।

দফায় দফায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষ। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কষ্টে পড়েছেন। সবকিছুর দাম কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে আসছে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। সাধারণ মানুষজন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির আশঙ্কায় রয়েছেন। পরিস্থিতি আরও প্রকট হবার আশঙ্কা করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থাও।

রমজানে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি। ডলার, এলসি খোলা, পণ্য খালাস প্রভৃতি নিয়ে সংকট কাটছিল না ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় রমজানে পণ্য প্রাপ্তি নিয়েও দেখা দেয় শঙ্কা। জানুয়ারিতে এলসি খোলার হার বাড়ায় স্বস্তি দেখছে সরকার। আরও কোনো সমস্যা হলে দেখবে বলেও জানাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে সারা বছর ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানেই খাওয়া হয় ৮০ হাজার টন ছোলা। সারাবছর ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকলেও, রমজানে লাগে ৫ লাখ মেট্রিক টন। মুসলিমদের সিয়াম সাধনার এ মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদাও বেশি থাকে। সারা বছর যেখানে ১৮ লাখ ৬২ হাজার টন চাহিদা, সেখানে রমজানেই প্রয়োজন হয় ৩ লাখ টন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সবশেষ জানুয়ারি মাসে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪১ টন চিনির জন্য এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছর (২০২২-এর জানুয়ারি) ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৪৯২ টন। এছাড়া জানুয়ারিতে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৩ টন তেলের জন্য এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৯ টন। একইভাবে বেশি খোলা হয়েছে ছোলা ও পেঁয়াজের এলসি। গত জানুয়ারিতে ২৯ হাজার ৪৮১ টন খেজুর আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১৬ হাজার ৪৯৮ টন ছিল। এছাড়া ৮ হাজার টন বেড়ে ৪২ হাজার ৫৬২ টন পেঁয়াজের জন্য এলসি খোলা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, রমজানের পণ্যে আর কোনো সমস্যা নেই। সবাই এখন এলসি খুলতে পারছে। তারপরেও কোনো সমস্যা হলে সে বিষয়ে সহায়তা দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ব্যবসায়ীরা এখনো শঙ্কা কাটার বিষয়ে ‘সায়’ দিচ্ছেন না। কিছুটা পরিস্থিতি উন্নতির কথা বললেও তারা সেটা পর্যাপ্ত মনে করেন না। তারা বলছেন, ভোগ্যপণ্য আমদানি সহজ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এলসি খোলার জন্য ডলার সংকট রয়েই গেছে। ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য ব্যাংকে নির্দেশ দিলেও সেটা সমাধান হয়নি। আবার বন্দরে আটকা পণ্যের জন্য এখনো তাদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এগুলোর প্রভাব পড়বে রমজানের পণ্যমূল্যে।

রমজানে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি। ছবি- সংগৃহীত।

এসব বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখনো আমরা সেটার কোনো সুফল পাইনি। ডলারের একটা রেট সরকার ধার্য করেছে। তবে এখনো এলসিতে ক্রাইসিস রয়েছে। আমরা ম্যানেজ করছি, কিন্তু সেটার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে। কোনো না কোনোভাবে সেটা হচ্ছে জটিলতার মধ্য দিয়ে।

রমজানের পণ্য খালাসে কোনো জটিলতা তাদের ছিল না জানিয়ে মোস্তফা হায়দার বলেন, আমরা আউটার থেকে পণ্য খালাস করি। সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। ডলার সংকটের কারণে এলসি না খুলতে পারার বিভিন্ন অভিযোগ ভিত্তিহীন জানিয়ে কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, রমজানে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। রমজান শুরুর আগে এসব এলসির পণ্য দেশে আসবে। সরবরাহ ও শৃঙ্খলা ঠিক থাকলে রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে এলসি দায় পরিশোধে সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়েছে ৯২০ কোটি ডলার। দেশের ইতিহাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এর আগে কখনই এত পরিমাণ ডলার বিক্রি করতে হয়নি।

আরো পড়ুন:
>৬২ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার তরুণী
>যাদের জন্য পেঁপে খাওয়া ক্ষতিকর

ডলার সংকটে বিল পরিশোধ না করতে পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন আমদানিকারকের পণ্য আটক করে গত মাসে। বিলম্বের জন্য তাদের পণ্য খালাসে বাড়তি জাহাজ ভাড়া ও জরিমানাও গুনতে হয়েছে। সেখানে এস আলম গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপের পণ্যও ছিল।

এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, বেশ জটিলতার পরে পণ্যগুলো বন্দর থেকে খালাস করা গেছে। তবে সেজন্য আমাদের বাড়তি ভাড়া ও জরিমানাও গুনতে হয়েছে। জাহাজের বিপরীতে প্রতিদিন ৪০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে, যা পুরোটাই লোকসান। বর্তমানে বন্দরে পণ্য খালাস পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ জাগো নিউজকে বলেন, কিছু কোম্পানির পণ্য খালাস হয়েছে। তবে সবগুলো খালাস হয়নি। কিছু জাহাজ এখনো আউটারে রয়েছে।

তিনি বলেন, যেগুলো খালাস হচ্ছে, সেটা বিলম্বে। কিন্তু একটি জাহাজ ১০-১২ দিন বসে থাকলে সেটার খরচ বাড়ছে। এগুলোর প্রভাব কিন্তু পণ্যের দামের ওপর পড়বে, যা অবশেষে ভোক্তাকেই বহন করতে হবে। গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা শুরু হয়েছে। জানুয়ারিতে বাড়লেও ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হয়েছে গত বছরের শেষ কয়েক মাস। তখন এলসি খোলায়ও দেখা দিয়েছিল চরম জটিলতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সময়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষ চার মাসে অপরিশোধিত চিনির এলসি আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। এছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেল ৯৯ শতাংশ, ছোলা ৪৭ শতাংশ ও খেজুর আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ।

ফেব্রুয়ারি ০৯.২০২৩ at ১১:১৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মেইস/ এসআর