নবীগঞ্জে হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে চলছে পাহাড় কাটা

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর অঞ্চলে ইচ্ছেমত চলছে পাহাড় কাটা। পরিবেশ ও প্রশাসনের উদাসীনতা ও কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় দিন-দিন পাহাড় কাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব পাহাড়ি মাটি চড়া মূল্যে বিক্রি করে অবৈধভাবে লাখ-লাখ টাকা অর্জন করছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র।

জানা যায়- ২০১৫ সালের ২২ আগস্ট একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘নবীগঞ্জে পাহাড় কাটা থামছে না’ শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন সংযুক্ত করে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ পক্ষে ওই বছরের (১৩ ডিসেম্বর) হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। (১৪ ডিসেম্বর) হাইকোর্ট পাহাড় কাটার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে রুল জারি করেন।

রুল শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায়ে- নবীগঞ্জের দিনারপুরে পাহাড় ও টিলা কাটা রোধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।এছাড়া হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ধারা ৬ এর (খ) স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক সরকারী বা আধা-সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না। যা সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তি যোগ্য অপরাধ।পরিবেশ আইন ও উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা থাকার পরও থেমে নেই পাহাড় কাটা।

২০১৬ সালের (১ নভেম্বর) পাহাড়ি অঞ্চল দিনারপুর এলাকায় পাহাড় কাটতে গিয়ে পাহাড় ধ্বসে দুই শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।এরপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে বছরের অধিকাংশ সময় দিনারপুর পরগণার পানিউমদা, গজনাইপুর ও দেবপাড়া ইউনিয়নে পাহাড় ও টিলা কাটা চলছে। দিনে কিংবা রাতের আধাঁরে অতি সু-কৌশলে পাহাড় কেটে উজার করে নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঙ্ঘবদ্ধ চক্র।

গত কয়েকদিন ধরে দিন-দুপুরে এবং রাতভর দেবপাড়া ইউনিয়নের দেবপাড়া বাজারের পাশ্ববর্তী ইয়াওর মিয়ার বাড়ির টিলা কেটে স্থানীয় একটি পুকুর ভরাট করছেন মাঠ বনগাঁও গ্রামের ওয়াহাব মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া। মাটি কাটায় জড়িত সেলিম ইতিপূর্বে পাহাড় কাটার মামলায় অভিযুক্ত। ‘টু ব্রাদার’ নামক বাহিনী তৈরি করে ওয়াহাব মিয়ার দুই ছেলে সেলিম ও সিরুল দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি বিভিন্নস্থানে বিক্রি করে আসছে।অন্যদিকে গত এক সাপ্তাহ পূর্বে স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার যোগসাজসে গজনাইপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল আলী ও সনর মিয়া গজনাইপুর গ্রামের হাছন মিয়ার ছেলে অলি মিয়া, তাজুল ইসলামের ছেলে সিরাজ মিয়ার মালিকানাধীন উঁচু একটি টিলা মেশিন দিয়ে কেটে সমতল করছেন।

নামমাত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধি দল সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তবে পরিবেশ আইনে মামলা করতে গড়িমসি করছে উপজেলা ভূমি অফিস ও পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশবিদরা বলছেন- উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, পরিবেশ আইন সঠিক ভাবে প্রয়োগ না করা ফলে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পাহাড়-টিলা কাটা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটার ফলে ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে আশপাশের ঘরবাড়ি। এসব বসতভিটা ভারি বর্ষণ হলে ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন- পাহাড়-বনভূমি সমৃদ্ধ হবিগঞ্জ জেলা। নবীগঞ্জ উপজেলায় পাহাড়-টিলা কাটা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ।কিছু সংখ্যাক প্রভাবশালী মানুষ নিজেদের ফায়দা নেওয়ার জন্য প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছে। এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশ জীববৈচিত্র্যের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতার কারণে পাহাড় ও টিলার যে শতশত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তা আজ ধ্বংসের পথে।

আরো পড়ুন:
>ঝিনাইদহের গাছ প্রেমিক অসিত বিশ্বাস, ইচ্ছা আছে ১ লক্ষ গাছ লাগানোর
>ঠাকুরগাঁওয়ে বাবাকে খুন করে থানায় ছেলের স্বীকারোক্তি

তিনি পাহাড়-টিলা কাটায় ও পরিবেশ ধ্বংসে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানান।পাহাড় কাটায় অভিযুক্ত সেলিম মিয়ার কাছে পাহাড় কাটায় প্রশাসনের অনুমতি রয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। মুঠোফোনে অলি মিয়া বলেন- আমরা এসিল্যান্ড সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আমাদের মৌখিকভাবে কাটার অনুমতি দিয়েছেন।

অভিযুক্ত সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল আলী টিলা কাটার সত্যতা অকপটে স্বীকার করে বলেন- আমরা কয়েকজন একত্রিতভাবে কাটতেছি।যোগাযোগ করা হলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন দেলোয়ার বলেন- পাহাড় বা টিলা কাটা আইনে সম্পূর্ণ নিষেধ, পাহাড় কাটার খবর পেয়ে আমরা অভিযান করছি, এরপর যদি কোথাও পাহাড় কাটা হয় আমরা ব্যবস্থা নিবো।

তিনি বলেন- আমাদের অফিস থেকে কে মামলা করবে, মামলা করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। আমি পরিবেশের উপ-পরিচালকের সঙ্গে কথা বলবো।এ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আখতারুজ্জামান টুকু বলেন- পাহাড়-টিলা কাটার বিষয়ে এসিল্যান্ড অবগত করবেন তারাই ব্যবস্থা নিবে। তিনি বলেন, আমাদের জনবল কম তাই সবসময় ঘটনাস্থলে যাওয়া সম্ভব হয়না।

ফেব্রুয়ারি ০৬.২০২৩ at ১৭:৫৭:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মেইস/এসআর