মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা কাব্যের আধুনিকতার ছোঁয়া

বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা ও কবি মধুসূদন। ছবি- সংগৃহীত।

প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে আধুনিকতা কাকে বলে বা আধুনিক শব্দের অর্থ কি? সাধারণত আধুনিক বলতে আমরা বুঝি সাম্প্রতিক, এখনকার, বর্তমান কাল, অধুনাতন অর্থাৎ নতুন বা নব্য। এক কথায় যে জিনিস, বিষয় কিংবা বিশ্বাস ও চেতনাবোধ বর্তমানকালে বা সাম্প্রতিক সময়ে জীবনে-সমাজে, মননে-চেতনায় উপলব্ধিতে বিশ্বাসে গ্রহণযোগ্য আসে বা হয় তাকেই আমরা মূলত আধুনিক অথবা আধুনিকতা বলি।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের নিরলস শ্রম ও আত্মপ্রচেষ্টায় বাংলা কাব্য ও সাহিত্য অনেক অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়েছে। তিনি যেমন বাংলাসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা তেমনি আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার। মহাকবি মধুসূদন মূলত একজন প্রতিভাবান কালজয়ী কবি। বাংলাসাহিত্যের যে বিষয়ের ওপর তিনি নজর দিয়েছেন- সে বিষয়টি নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়েছে এবং বিকশিত হয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে।

বাঙলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, বাঙলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের অমর কারিগর রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের বাঙলা কবিতার ভূবনে প্রথম আধুনিক ও কালজয়ী কবি এবং আধুনিকতার প্রবর্তক। সেদিক থেকে তার সকল সৃজনশীল রচনা সময়ের দাবিতে, সমকালের আহ্বানে, আমাদের বিশ্বাস ও চেতনার মাঝে ব্যাপকতর গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

বাঙলা সাহিত্যের বিশাল সৃষ্টিশীলতার আকাশে বৈচিত্রময় প্রতিভাময় প্রতিভার অধিকারী। ছবি- সংগৃহীত।

ঋণজন্মা কালজয়ী এই মহাপুরুষের হাত ধরেই বাঙলা কবিতায় নবতর আধুনিকতা এসেছে। শুধু বাঙলা কবিতায় বলি কেনো বাংলা সাহিত্যের যে আধুনিকতা তাও কবি মদুসূদনের এক অপার বিস্ময়কর সৃষ্টি। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই যুগস্রষ্টা ও আধুনিক বাংলাসাহিত্যের পথিকৃত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের অহংকার, গৌরব ও বাঙালি জাতীয় সত্তার ও চেতনার প্রতীক।

১৮৬২ সালে ৯ জুন কবি মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার সময়ে ভীষণভাবে এক অর্থাকষ্টে পড়েছিলেন। কাজেই বাঙলা কবিতায় যে আধুনিকতার রূপ, রস, গন্ধ, ছন্দ ও ভাব খুঁজে পাই তার ধারক ও বাহক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন। সমাজ-সভ্যতা, মানুষের যাপিতজীবন, ধর্ম ও বিশ্বাস প্রভৃতি বিষয়ের ওপর কবি মধুসূদনের যে চেতনা বিশ্বাস উপলব্ধিবোধ তা তিনি সুন্দর করে আধুনিকতার আদলে, রঙে ও ঢঙে বাঙলা কবিতায় এবং সাহিত্যে সৃষ্ট করেছেন।

আর তাই আধুনিক বাঙলা কবিতার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র অগ্রদূত এবং একজন আধুনিক কবি তা আমাদের শিক্ষিত-বাঙালী বলতেই জানেন এবং মনে প্রাণে মানেন। আমরা জানি কবি মধুসূদন যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে বাঙলা কবিতা অত্যন্ত জরাগ্রস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিকাল পার করছিল।

আরো পড়ুন:
>শার্শায় উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মশিউর ও রফিকুলের বিরুদ্ধে অর্থ বানিজ্যের সংবাদ
>ঝিকরগাছা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠন

বাঙলা সাহিত্যাকাশে কবি মধুসূদনের আগমনে সেই জরাগ্রস্ত বাঙলা কাব্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেলো ও নতুনের দোলায় উদ্ভাষিত হয়েছে। কবির নিরলস শ্রম ও আপ্রাণ চেষ্টায় বাঙলা কবিতা সাহিত্য আজ আধুনিকতায় অনেক অনেক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তিনি যেমন বাঙলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা ও দিকপাল, তেমনি আধুনিক বাঙলা কাব্যের রূপকার। কবি মধুসূদন বাঙলা সাহিত্যে বিশেষ করে নজর দিয়েছেন কাব্যে তা আজ আধুনিকতার পরশে বিকশিত হয়ে ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে।

একথা সত্যি যে, মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে আঠারো শতকে বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার সেই যে অংকুর বীজ বপন করা হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান কাল পর্যন্ত বাঙলা কাব্যে আধুনিকতার প্রসার প্রচার ঘটছে। আজ আমরাও একই সুরে বলতে চাই যে, বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা মহাকবি মাইকেলেরই সৃষ্টি, বাঙলা সাহিত্যে যে আধুনিকতা তাও মাইকেলের সৃষ্টি এবং আরো স্পষ্ট করে বলতে হয় বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা আর মহাকবি মধুসূদন যেনো একে অপরের পরিপূরক।

কালপুরুষ মধুসূদন বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার যে ধারা প্রকাশ করেছেন। ছবি- সংগৃহীত।

আমরা দেখতে পাই মাইকেলের বিভিন্ন রচনায় কি কবিতায়, কি মহাকাব্যে, কি নাটকে, কি প্রহসনে সবখানে মানবতাবাদী চেতনা কল্যাণবোধের প্রবলভাবে প্রকাশ ঘটেছে। তিনি মহাকাব্য রচনা করে যে সফল ও স্বার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন, সেখানেও আধুনিকতা ও বিদ্রোহের প্রকাশ করেছেন। ফলে জোর গলায় বলা যেতে পারে যে, মাইকেল তার লেখার মধ্যে সতত সুন্দর ও মানবতারই জয়গান গেয়েছেন। আর এখানেই আমাদের চাইতে কবি মধুসূদন অনন্য ও বিরল প্রতিভা।

কালপুরুষ মধুসূদন বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার যে ধারা প্রকাশ করেছেন তা মূলত মানবিকতা অর্থাৎ মানবতাবাদের বাস্তব প্রয়াস। এখানে তার অমর সৃষ্টি মহাকাব্য “মেঘনাদবধ” কাব্যে মানবতাবাদের যে চেতনা প্রকাশ করেছেন সেখানে একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, লংকার অধিপতি রাবণ চরিত্রে স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন একান্ত মানবতাবাদের। এছাড়া শিল্পবোধের আলোকে ভয়ংকর রাবণকে মানুষের কাছে সমাজের সামনে তিনি মানবিক দৃষ্টিতে দাঁড় করিয়েছেন।

পুত্র হারানো যে কতোটা কষ্টের ও শোকের এবং একজন পিতার বিলাপ কতো বেশি এই কাব্যে তা মানবিকভাবে উঠে এসেছে। পাশাপাশি তার “বীরাঙ্গনা” কাব্যতে দেখতে পাই সেখানে পৌরানিক অনেক নারীকে কবি তাদের কুসংস্কার অন্ধত্ব গোড়ামী ও ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের করে এনেছেন এবং তাদের কণ্ঠ থেকে আধুনিকতা ও প্রগতি ছোঁয়ায় মানবতার কথা উচ্চারণ করিয়েছেন। উক্ত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের মাধ্যমে সমাজে পরিবারে নিষ্পেষিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের মুক্তির জন্য সাহসিকতার জয়গান গেয়েছেন।

আরো পড়ুন:
>শার্শায় উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মশিউর ও রফিকুলের বিরুদ্ধে অর্থ বানিজ্যের সংবাদ
>ঝিকরগাছা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠন

এছাড়া ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে কবি মধুসূদন আধুনিকতার রঙে এক বিরহের চিত্রই এঁকেছেন। এখানে কৃষ্ণ বিরহের চিত্রই এঁকেছেন। এখানে কৃষ্ণ বিরহে রাধিকার হৃদয়ে পাহাড়সম বেদনা, কষ্ট ও যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয় এই কাব্যে রাধাকে তিনি একজন মানবী হিসেবে তৈরি করেছেন। প্রেম চিরন্তন সত্য ও ধ্রুব সেটা এই কাব্যে কবি মধুসূদন তার আধুনিক ভাব, চিন্তা ও কাব্যচেতনার এক উজ্জ্বল নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। কবির অনবদ্য সৃষ্টি ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যও আধুনিকতার প্রকাশ।

এমনকি তার কবিতায় আধুনিকতার অন্যতম দিক হিসেবে আমরা পেয়েছি স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনাবোধ। আর সেটা ভালো করে কবি মধুসূদন তার কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিকতার পরশে। তার সনেট কবিতায় পরতে পরতে আধুনিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ মানুষ প্রকৃতি এবং নদ-নদীর ক্ষেত্রে তিনি ভালোবাসা স্বাধিকার চেতনা মূল্যায়ন করেছেন। বর্তমান বাঙলা কবিতায়ও তার স্পষ্ট চিত্ররূপ দেখা যায়।

বাংলা কবিতা আধুনিকতার পরশে বিশ্বসাহিত্যে এক উত্তমরূপে স্থান করে নিয়েছে। ছবি- সংগৃহীত।

এখন আমাদের বলতে মোটেও দ্বিধা নেই কবি মধুসূদনের জন্যই বাংলা কবিতা আধুনিকতার পরশে বিশ্বসাহিত্যে এক উত্তমরূপে স্থান করে নিয়েছে। এর ফলে বিষয় ও শিল্পের দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কবি মধুসূদনের সমগ্র কাব্যশিল্পে মূলত আধুনিকতার প্রকাশ পেয়েছে। বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার যে রূপ তা কবির অবদান। কবি মধুসূদনের জন্যই বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার রঙে অনেক দুর অগ্রসর হয়েছে এবং ক্রমশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। আর তাই বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই কবি মাইকেলের নামটিই উচ্চারিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। যেমনটি ঘটেছে ইংরেজ কবি টি এস ইলিয়টের ক্ষেত্রে।

বিশ্ব সাহিত্যে ইংরেজ কবি টিএস ইলিয়টের কবিতায় যেমন ইংরেজি কবিতায় নতুন ও আধুনিকতা এসেছে, তেমনি আমাদের বাঙলা সাহিত্যের পথিকৃত যুগ স্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূদনের কবিতায় প্রথমে আধুনিকতা এসেছে এবং বাঙলা কবিতায় যে আধুনিকতা তা মাইকেলের অমর সৃষ্টিরই বহিঃপ্রকাশ।

মোদ্দাকথা কবি মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দের চতুর্দশপদী পত্রকাব্য মহাকাব্য গীতি কবিতা রচনা করে বাঙলা কবিতায় যে আধুনিকতার অবদান রেখেছেন ও অমূল্য স্মারক নির্মাণ করেছেন তা কবিকে সাহিত্যপ্রেমিদের ও নতুন প্রজন্মদের কাছে চিরভাস্মর করে রাখবে। আর সে কারণেই বাঙলা কবিতায় আজ যে আধুনিকতার শিল্পরূপ, ছন্দ তৈরি হয়েছে তার সম্পূর্ণ ভাগিদার মাইকেল মধুসূদন।

কেননা জীবন চিন্তা-চেতনা ভাব মনন সমকাল শিল্প বিষয়ে তার বৈচিত্রময় সৃষ্টিশীল রচনা আধুনিকতার বাহক হিসেবে প্রতীয়মান। বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার রূপ নির্মাণ করে কবি তার সকল রচনাতে আধুনিকতার ছাপ রেখেছেন। ফলে বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার উপস্থিতিতে জানতে বুঝতে হলে মধুসূদনের রচনা পাঠের বিকল্প নেই। তার অমরকৃতি রচনাসমগ্র আমাদের বারবার পাঠ করতে হবে।

আরো পড়ুন:
>শার্শায় উপ-সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মশিউর ও রফিকুলের বিরুদ্ধে অর্থ বানিজ্যের সংবাদ
>ঝিকরগাছা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠন

যেহেতু মাইকেল মধুসূদন তার চিন্তা চেতনা ভাব দর্শন ব্যক্তিত্ব স্বাতন্ত্রবোধ প্রকাশ করেছেন কবিতায় আধুনিকতার মধ্য দিয়ে। আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি মাইকেলের অবদান ভূমিকা যে কতো বেশি সে বিষয়ে প-িত, সুলেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ড. আহমদ শরীফ যথার্থই বলেছেন ‘মধুসূদন ভাবে ভাষায় ছন্দে আঙ্গিকে যা কিছুই আনলেন তা এ দেশে নতুন বটে। তবে তাতে সমকালীনতা বা স্বাদেশিকতা ছিলো না, ছিলো আধুনিকতা মধুসূদনের আধুনিকতার এ বৈশিষ্ট্যই তাকে আজো কালপ্রবাহে চিরঞ্জীব অমর অক্ষয় অপরাজেয় করে রেখেছে।

একথা জোর করে বলা যেতে পারে, আমাদের বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার অপূর্ব নির্মাণ সৃষ্টি ও কারুকার্যময় করে তুলেছেন বাঙলা কবিতার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কবি মধুসূদন বাঙলা কবিতায় সৃষ্টিশীলতায়পূর্ণ নব দিগন্তের উন্মেষ সূচনা করেছেন। জয়তু আধুনিক বাঙলা কবিতা, জয়তু কবি মধুসূদন।

জানুয়ারি ২৬.২০২৩ at ২০:১৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর