সংসদে সব নাগরিকের জন্য পেনশন বিল’ পাশ

ছবি: সংগৃহীত

বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন বিল-২০২২’ পাশ হয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিলটি পাশের জন্য প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে বিলটি পাশ হয়ে যায়।

নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতে সংসদে এ ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ পাস করেছে। বিলে ১৮ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক নির্ধারিত হারে চাঁদা পরিশোধ করে ৬০ বছর পূর্তির পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্বরাও এই আইনের আওতায় নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করে পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

সেক্ষেত্রে স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা দেয়া শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স হতে আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন। আজীবন বলতে পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়েছে। এরআগে বিলের ওপর আনীত জনমত যাচাই, বাছাই কমিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো কন্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তবে কতিপয় সংশোধনী গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী।

আরো পড়ুন:
> সংসদে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করলেন অর্থমন্ত্রী
> দর্শনার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত হচ্ছে বঙ্গভবন

বিলে বলা হয়েছে, একজন পেনশনার আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরৎ দেয়া হবে।

এতে আরো বলা হয়েছে, পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। আইনে পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে বলে জানান হয়েছে।

এর আগে বিলটি পাশের ব্যাপক বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারে এ বিলের কথা উল্লেখ ছিল। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ লাখ মানুষ চাকরি করে, বাকিটা বাইরে। বিলে বলা আছে দেশের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র, দুস্থ অসহায় জনগোষ্ঠির জন্য বিলটি আনা হবে। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকার- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা নিশ্চিত করবে।

ছবি: সংগৃহীত

আর ১৫ (ঘ) ধারার দেশের অভাবগ্রস্থ, দুস্থ ও অসহায় মানুষ সরকারি সহায়তা পাবেন। এটা আগে থেকেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তাহলে বিলটি কেন আনা হচ্ছে? এটা সংবিধানের সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এতটা খারাপ যে জনগণ পেনশনের এ বিলে টাকা দেবে কিনা তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

যেভাবে দেশের অর্থ বিদেশ পাচার হচ্ছে, কানাডায় বেগম পাড়া হচ্ছে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় পাচার হচ্ছে, ব্যাংক লুটপাট করে বিদেশে অর্থ চলে হচ্ছে, তার কোনটিই অর্থমন্ত্রী ফেরৎ আনতে পারেননি। আবার জনগণের এ অর্থ তো ব্যাংকে থাকবে, গরীব মানুষের এসব অর্থ ফেরৎ পাবে তার কোন গ্যারান্টি নেই এ বিলে। কারণ ব্যাংক মালিক, ম্যানেজাররা মিলে ঋণ দেবার নামে ব্যাংক লুটপাট করে আবার অন্যকে সুযোগও দেয়। এমনকি এটা বন্ধ করতে তিনি কোন যথার্থ উদ্যোগই নেননি। এ সময় চুন্নু অর্থমন্ত্রীকে এ বিষয়ে কিছু বলার জন্য আহ্বান জানান।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এই সর্বজনীন পেনশনটাকে বেসরকারি একটি প্রফিডেন্ট ফান্ডের বাইরে আমার কিছু মনে হচ্ছে না। যে আপনি কিছু টাকা দেবেন আর সরকার দেবে মুনাফা, কি মুনাফা দেবে তাও বিলে স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। কারণ ১৫ (ঘ) তে বলা আছে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে জনগণের বাধ্যক্যকালীন চিকিৎসা, স্বাস্থ্য তার রোগ ব্যাধির চিকিৎসা দেবে। রাষ্ট্র কি তাহলে কন্টিবিউশন দিয়ে নিশ্চিত করবে? রাষ্ট্রটি তাহলে জনগণের চাঁদা দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করবে? এটা তো সংবিধান এলাও করছে না। এটা জাস্ট একটা প্রফিডেন্ট ফান্ড মাত্র।

তিনি বলেন, বিলটি সার্বজনীন হচ্ছে না, এখানে (বডি) বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আছেন, অর্থমন্ত্রী আছেন, সচিবরা আছে সিকিউটিরি এক্সসেন্স-এর প্রতিনিধিরা আছেন। সেখানে এমপিও নাই, অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা নাই, জনগণের প্রতিনিধিও নাই। জাস্ট একটা ব্যবসায়ী ক্লাবের কমপোজিশন। তিনি জনগণকে কি মানাফা দেয়া হবে তার সুষ্পষ্ট ব্যাখা জানতে চান। পীর ফজলুর রহামন বলেন, সাধারণত বিশ্বের চার ধরনের পেনশন স্কিম চালু রয়েছে- একটা হচ্ছে ফান্ড, আন ফান্ড, ডিফাইন বেনিফিট এবং আর একটা হচ্ছে ডিফাইন কনট্রিবিউশন। তবে এটি আসলে কোন ধরনের পেনশন তা পরিষ্কতার না।

ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, যে টাকা জমা হবে তার নিরাপত্তাটা কোথায়, এ বিশাল অঙ্কের অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করা হবে তার উল্লেখ নেই। কাজী ফিরোজ রশীদ এই বিলটাকে ‘শিয়ালের কাছে মুরগী রাখা’র উদাহরণ টেনে বলেন, জনগণ তাদের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাংকে রাখবে আর ব্যাংক ওয়ালা তা দেদারসে বিদেশে পাচার করে দেবে। ব্যাংকের ওপর থেকে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তিনি জনগণের টাকা ব্যাংকে নেবার একটা ফাঁদ, ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার নেই দেখাও নেই।

ফিরোজ বলেন, দেশে খেলাপী ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, পাচার হচ্ছে। এদেশে ২০১৯ সালে ঋণ খেলাপীদের সবচেয়ে সুবিধা দেয়া হয়। পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে মামলা হয়েছে ৭৫২টি, বিদেশে মানিলন্ডারিং মামলা ১১৯ টি, তদন্ত চলছে ৩৫০টি, বিচার হয়েছে মাত্র ১০টির। অর্থাৎ আমরা টাকা রাখবো, সে টাকা তো পাচার হয়ে যাবে। কেননা মানিলন্ডারিংকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। কানাডার বেগম পাড়া, সিঙ্গাপুরে, মালয়েশিয়া, কয়েতসহ বহু দেশে আমাদের দেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির বাড়ি আছে , জমি আছে।

হাইকোর্ট বারবার বলছে এসব লোকের তালিকা দিন, কই দেয়া হচ্ছে কই? স্বতন্ত্র এমপি রেজাউল করিম বলেন, সরকারি চাকুরীজীবীরা ৩২-৩৫ বছর জীবনপাত করে চাকরি করেও পেনশন পায়নি। তিনি বলেন, অনেক চাকুরীজীবী আছেন যারা বছরের পর বছর পেনশনের জন্য জুতার তলা ছিড়ে ফেলছেন, কিন্তু তারা পেনশন পাচ্ছেন না। আর সাধারণ মানুষ যারা পেনশন কোথা থেকে পাবেন তার বারান্দা পর্যন্ত দেখেননি, চেনেন না, তারা কি সত্যি ৬০ বছর বয়সে গিয়ে জীবনের এসব সঞ্চয় তুলতে পারবেন? এ আমি বিশ্বাস করি না। কেননা তার আগে ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাবে। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।

জানুয়ারি ২৪, ২০২৩ at ২০:৪৯:০০(GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ/ইমস