‘সলঙ্গা বিদ্রোহ’ চাপা পড়া ইতিহাস

তিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবসের ১০১ বছর। মূলত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে সূত্রপাত হয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের।জালিয়ানওয়ালাবাগের পথ ধরে ব্রিটিশ বেনিয়াদের নৃশংসতার আরেক রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয় সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়।

১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি তরুণ নেতা মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এর নেতৃত্বে তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার সলঙ্গা হাটে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ঐ দিন প্রায় ১২০০ প্রতিবাদী মানুষ ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শাহাদাত বরন করেন। আহত হয় প্রায় ৪৫০০-এরও বেশি। নিহতদের লাশের সাথে সংজ্ঞাহীন আহতদের উঠিয়ে নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে গণকবর দেয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনে জনতা উদ্বেলিত হয়ে বিলেতি পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। সে সময় সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় সপ্তাহে ২ দিন হাট বসত। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার ছিল বড় হাটের দিন।

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা বিলেতি পন্য কেনাবেচা বন্ধ করতে হাটে নামে। আর এই স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের রুখতে ছুটে আসেন পাবনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আর, এন, দাস জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এস, কে সিনহাসহ ৪০জন সশস্ত্র লাল পাগড়ীওয়ালা পুলিশ। সলঙ্গার গো হাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশী কর্মীদের অফিস। পুলিশ কংগ্রেস অফিস ঘেরাও পূর্বক গ্রেফতার করে মাওলানা আব্দুর রশিদকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্ত করতে সেদিন ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সলঙ্গার ৪০ হাজার সংগ্রামী জনতা।

১৯২২ সালের ২৭ শে জানুয়ারি শুক্রবার ছিল বড় হাট বার। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে নামেন বিলেতি পণ্য কেনা-বেচা বন্ধ করতে। আর এ স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের রুখতে ছুটে আসে পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরএন দাস জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রসাশক এসকে সিনহাসহ ৪০ জন সশস্ত্র লাল পাগড়ীওয়ালা পুলিশ। সলঙ্গার গো হাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের অফিস। পুলিশ কংগ্রেস অফিস ঘেরাও পূর্বক গ্রেফতার করে মাওলানা আব্দুর রশিদকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্ত করতে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিদ্রোহে ফেটে পরে সলঙ্গার সংগ্রামী জনতা।

পুলিশ এসে তার ব্যাটিলিয়নদের নিয়ে কংগ্রেস অফিস ঘেড়াও দিয়ে গ্রেফতার করে নেতৃত্বদানকারী মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যে থেকে ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও মহুকুমা অফিসারকে ঘিরে জনতা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে উদ্ধারের জন্য মিছিল বের করে। জনতার ঢল ও আক্রোশ দেখে ম্যাজিষ্ট্রেট জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। শুরু হয় বুলেট-বৃষ্টি।

৪০টি রাইফেলের মধ্যে মাত্র একটি রাইফেল থেকে কোনো গুলি বের হয়নী। ঐ রাইফেলটি ছিল একজন বাঙ্গালী পুলিশের। এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডে হতাহতের সরকারি সংখ্যা ৪৫০০ দেখানো হলেও বেসরকারি মতে ১২০০০-এরও অধিক হবে বলে জানা যায়। সলংগা হাটের হত্যাকান্ডের ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর নৃশংস। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথা শতাব্দির গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে চাপা পড়ে আছে।

বস্ততপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯২২ সালের বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সলংগা হত্যাকান্ডের ঘটনা যেমন সবচেয়ে নৃশংস পাশবিক তেমনি নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। মাওলানা আব্দুর রশিদ সলঙ্গা বিদ্রোহ উপনিবেশিক শাসনের ভিত লড়িয়ে দিয়েছিলেন। সলঙ্গার রক্তসিক্ত বিদ্রোহ শুধু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেনি, সিক্ত করেছে সমগ্র উপমহাদেশ। যে রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তা সলঙ্গা বিদ্রোহেরই ফসল।

শত বছর পর একথা অনেকের কাছে নতুন ও বিস্ময়কর মনে হতেই পারে। এটা স্বাভাবিক কারণ তৎকালিন সেদিন পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) সলঙ্গার হাটের যে গণ বিদ্রোহ ও হত্যাকান্ড ঘটেছিল তা নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। এখনও হয় না। কালক্রমে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে স্বাধীনতার ইতিহাস এর মধ্যে বাঙ্গালী মুসলমান নেই বললেই চলে। ফলে মুসলমানদের বীরোচিত কাহিনী এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দুঃখজনক শুধু নয় বিস্ময়করও বটে যে এ ঘটনাটি ইতিহাসের কাদায় চাপা পড়ে গেছে।

তবে, মাওলানা আব্দুর রশিদ সলঙ্গা বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন। সলঙ্গার রক্তসিক্ত বিদ্রোহ শুধু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেনি, সিক্ত করেছে সমগ্র উপমহাদেশ। যে রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তা সলঙ্গা বিদ্রোহেরই ফসল।

২৭ জানুয়ারি ব্রিটিশবিরোধী আজাদি লড়াইয়ে সলঙ্গা আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে ইতিহাসে। তযাদের শাহাদাতের রক্তপিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে ভারতবর্ষ থেকে এক সময় শোষণের হাত গুটাতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা, এবং এই পথ ধরেই কিছুকাল পরে আমরা পেয়েছি স্বাধীন একটি ভূখণ্ড— স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। পেয়েছি একটি মানচিত্র আর লাল সবুজের পতাকা। ‘সলঙ্গা বিদ্রোহ’ চাপা পড়া ইতিহাস। এই ইতিহাস তুলে আনতে হবে আমাদের স্বার্থেই।

সলঙ্গা বিদ্রোহের নেপথ্য নায়ক ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তর্কবাগীশ ও সলঙ্গা বিদ্রোহ অবিচ্ছেদ্য। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সিংহপুরুষ। তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে বাঙালি ছাত্রদের অধিকার আদায়ে গঠন করেন ‘আজাদী সমিতি’। লাহোরের বিখ্যাত এশায়েতুল ইসলাম কলেজে অধ্যয়নকালে ‘তর্কবাগীশ’ উপাধিতে ভূষিত হন। পরবর্তী সময়ে দরিদ্র কৃষক সমাজের কল্যাণে গঠন করেন ‘নিখিল বঙ্গ রায়ত খাতক সমিতি’। সমিতির সেক্রেটারি হন তিনি নিজে এবং সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

এ সমিতির আন্দোলনেই গঠিত হয় ঐতিহাসিক ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’। এরপর তিনি যোগ দেন মুসলিম লীগে। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৬ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলন চলাকালীন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি করলে প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে তিনি একাই ঝলসে ওঠেন। তিনি সেখানে বলেন, ‘ছয়জন ছাত্র মৃত্যুশয্যায়, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব-এ আমি বরদাশ্ত করতে পারি না। আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে এ পরিষদগৃহ ত্যাগ করছি।

পরবর্তী সময়ে তিনি গ্রেফতার হয়ে ১৮ মাস কারাবন্দি থাকেন। আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৭০ সালে তিনি এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে জাতীয় পরিষদের প্রথম সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেন। ১৯৭৬ সালে ‘গণ আজাদী লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

তর্কবাগীশ জন্মেছিলেন ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বরে সলঙ্গারই এক অজপাড়া গ্রাম তারুটিয়াতে। সম্ভ্রান্ত এক পীর পরিবারে জন্ম নেওয়া এ মানুষটির পুরো জীবনটাই ছিল সংগ্রামমুখর। ১৯১৪ সালে তিনি শেরপুর ডায়মন্ড জুবিলী হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি গরিব কৃষক ও দুধ বিক্রেতাদের সংগঠিত করেন। তাদের নিয়ে স্থানীয় জমিদারের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। জমিদারদের দুধ সরবরাহ বন্ধ করে প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে তার সংগ্রামী জীবনের উদ্বোধন হয়।

তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হয়েও এন্ট্রান্স পরীক্ষার্থী থাকাবস্থায় যোগ দেন ১৯১৯ সালের ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে। নিজের নেতৃত্বে এলাকার ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে চালিয়ে যেতে থাকেন ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলন। সেই থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি সলঙ্গার মাটিতে।

২৭ জানুয়ারি সেই রক্তে আগুন জ্বালানো দিন। আমরা গর্বিত আমরা সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের উত্তরসূরি। আজকের এই দিনের তার অমর স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা।

★ লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন।

জানুয়ারি ২৪.২০২৩ at ১৭:৪১:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর