বদলগাছীতে ফসলি জমির মাটি বিক্রির মহোৎসব

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কসবা গ্রামে ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রির চলছে মহোৎসব । জমির মালিকেরা তাঁদের জমি ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটার মালিক ও রাস্তার ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করছেন। জমি থেকে গভীর করে মাটি তোলায় আশপাশের ফসলি জমিগুলোতে ধস দেখা দিয়েছে। এভাবে মাটি কাটা অব্যহত থাকলে কসবা গ্রামের ফসলি মাঠটি খাল-বিলে পরিণিত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

তাঁদের অভিযোগ, ৮/১০ বছর ধরে কসবা গ্রামের ফসলি মাঠের জমির মাটি কাটার চলছে মহোৎসব । এখন মাঠের অনেক জমির শ্রেণি পরির্বতন হয়ে গেছে। ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধের জন্য ভূমি অফিস, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। সরেজমিনে কসবা গ্রামে ফসলি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ফসলি মাঠটিতে মাটি কাটার চলছে। গ্রামের ফসলি মাঠটির ৮/১০টি স্থানে বিশাল অংশজুড়ে দুই/তিন ফসলি জমি গভীর করে মাটি কাটার কাজ চলছে।

প্রতিটি স্থানেই এক সঙ্গে ৫-৬ টি ট্র্যাক্টর এসে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। অবাধে ট্র্যাক্টর চলাচল করায় সাগরপুর থেকে কসবা গ্রাম পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার পাঁকা সড়কটি নষ্ট হয়ে গেছে। সাগরপুর গ্রাম থেকে ৫ থেকে ৬শ গজ দূরে কসবা ফসলি মাঠে নেমে দেখা গেল, সেখানে ৪-৫ বিঘা জমিজুড়ে গভীর করে মাটি কেটে ট্র্যাক্টরে তোলা হচ্ছে। সেখানে একটি লোক টালি খাতা নিয়ে বসে আছে। সেই খাতাই ফসলি জমির মাটি বিক্রির হিসেব লিপিবদ্ধ আছে। প্রতি ট্র্যাক্টর মাটি ৪০০ টাকা করে বিক্রি দেওয়ার কথা লেখা রয়েছে।

ওই জমি থেকে গভীর করে মাটি কাটায় সেটি এখন খালে পরিণিত হয়েছে। ইটভাটা ও রাস্তার কাজে সেখান থেকে ফের মাটি কাটায় আশপাশের উচুঁ জমিগুলো ধসের হুমকিতে রয়েছে। সেখানে থাকা একটি ট্র্যাক্টর চালক বলেন, আমার বাড়ি কসবাতেই। জমির মালিক তাঁর জমিটি এক ব্যক্তিকে ইজারা দিয়েছেন। ইজারাদারেরা প্রতি ট্র্যাক্টর মাটি ৪০০ শত টাকা দাম নিচ্ছে। রাস্তার ঠিকাদার ও ইটভাটার মালিক প্রতি ট্র্যাক্টর মাটি সাড়ে ৮শ টাকায় কিনছেন। প্রতিদিন গড়ে একটি ট্র্যাক্টর ১৫ থেকে ২০ টি ট্রিপ দিচ্ছে। আকের ট্র্যাক্টর চালক বলেন, আমরা শাহিনের ইটভাটায় মাটি নিয়ে যাচ্ছি।ওই স্থানটির প্রায় ৫০ গজ দূরত্বে একইভাবে মাটি কাটার কাজ হচ্ছিল।

আরো পড়ুন:
>অফিসে টানা বসে কাজের অভ্যাসে বাড়ছে অসময়ে মৃত্যুঝুঁকি!
>চাকরির সুযোগ দিচ্ছে আইপিডিসি ফাইন্যান্স

সেখানে ৪-৫ টি ট্র্যাক্টর এসে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। এই স্থান থেকে ৭০ গজ দূরুত্বে গিয়ে দেখোযায় আরেক দৃশ্য সেখানে ৩/৪ বিঘা জমি জুড়ে চলছে একই ভাবে মাটি কাটা । এই মাটি কাটতে গিয়ে বরেন্দ্রর ডিপটিওবয়েলের আন্ডারগাউনের প্রায় ১২০ থেকে ১৬০ ফিট পাইপ ফেটে তুলে ফেলেছে। মাটি কেটে নেওয়ার কারণে সেই স্থানটি খালে পরিণিত হয়েছে। উঁচুতে থাকা জমি গুলোর মাটি ধসের হুমকিতে রয়েছে।

কসবা, সাগরপুর ও পচাঁরমোড়ের গ্রামবাসীরা জানান, বিগত ৮/১০ বছর আগে থেকে কসবা ফসলি মাঠ থেকে মাটি বিক্রির শুরু হয়। ৫-৬ জন জমির মালিক তাঁদের জমির বালু ও মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা দুই/তিন ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটার মালিক ও রাস্তার ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করছেন। আর প্রতিদিন গড়ে ২-৩ শ ট্র্যাক্টর বালু ও মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে এই মাঠ থেকে। গভীর করে মাটি কেটে নেওয়ার কারণে উচুঁ ফসলি জমি ধসে পড়ছে। এখন পুরো মাঠজুড়ে ৬-৭ টি স্থানে মাটি কাটার কাজ চলছে। অবাধে ট্র্যাক্টর চলাচল করায় গ্রামের সড়কটি নষ্ট হয়েছে।

ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি বন্ধ করতে তাঁরা ইউনিয়ন ভূমি অফিস, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু একাধিক জনপ্রতিনিধি ইটভাটা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁরা কোন ব্যবস্থা নেননি। ইটভাটার মালিকদের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। ফলে ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিষয়টি নজর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

আরো পড়ুন:
>অফিসে টানা বসে কাজের অভ্যাসে বাড়ছে অসময়ে মৃত্যুঝুঁকি!
>চাকরির সুযোগ দিচ্ছে আইপিডিসি ফাইন্যান্স

ঐ এলাকার বাসিন্দা সবুজ , সোহেল, জাহিদ , মুনজুর ও আরমান সহ বেশ কিছু ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফসলি জমি কেটে মাটি বিক্রি বন্ধের জন্য ভূমি অফিস, ইউএনও অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদ সবখানে গেছি। কিন্তু কেউ মাটি কাটা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি। আমরা গরীব মানুষ আমাদের জমিজমা ধসে গেল কারও কিছুই যায় – আসে না। কসবাগ্রামের বাসিন্দারা বলেন, গত ২০১৫ সালে র‌্যাব সদস্যরা এসে কসবা পচাঁর মোড়ে ট্র্যাক্টরসহ মাটি উত্তোলনকারীকে ধরেছিল। তারপরও এখানে মাটি কাটার কাজ বন্ধ হয়নি।

একই গ্রামের হরিপদ, আরমান, ফজলু সহ বেশ কিছ’ ব্যক্তিরা বলেন, ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি দেওয়ায় মাঠের অন্য জমিগুলো ধসের সৃষ্টি হয়েছে। অবাধে ট্র্যাক্টর চলাচল করায় গ্রামের সড়কটি নষ্ট হয় গেছে। সড়কটি দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করা যাচ্ছে না। ইউএনও, স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যানকে তাঁরা ঘটনাটি জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাটি ব্যবসায়ী বলেন, জমিতে ফসল হয় না। তাই জমির মালিক আমাদের কাছে জমির মাটি বিক্রি করছেন। এতে ফসলের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন তিনি।

ভূমি অফিস সুত্রে জানাযায়, কোন জমির মালিক নিজ ইচ্ছে মতো জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারবেনা। কেউ নিজ ইচ্ছে মতো জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বদলগাছী উপজেলা কৃষি অফিসার সাবাব ফারহান বলেন, ফসলি মাঠে জমির উর্বর মাটি কেটে বিক্রি দেওয়ায় অন্য জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জমির শ্রেণিও পরিবর্তন হচ্ছে।

আরো পড়ুন:
>অফিসে টানা বসে কাজের অভ্যাসে বাড়ছে অসময়ে মৃত্যুঝুঁকি!
>চাকরির সুযোগ দিচ্ছে আইপিডিসি ফাইন্যান্স

আমি বিষয়টি আমার উদ্ধর্তন কতৃপক্ষকে জানাবো।  বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বদলগাছী কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোশাব আলী বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সাগরপুর গ্রাম থেকে কসবা গ্রাম পর্যন্ত আটশ মিটার সড়ক পাঁকাকরণ করেছে বলে আমি জেনেছি। মাঠের মাটি উত্তোলন কাজে ডিবটিওবয়েলের আন্ডারগাউন্ড এর পাইপ ফেটে ফেলার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এবিষয়ে বদলগাছী সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিয়া খাতুন এর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মৌখিক অভিযোগে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার নিয়ম নেই। বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বলেন, কসবা গ্রামে ফসলি জমির বালু ও মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বলে আমি একটি মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। আমি সেখানে তৌসিলদারকে পাঠিয়েছি শ্রেণী পরিবর্তন হচ্ছে কিনা আগে যেনে নেয়। তারপর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

জানুয়ারি ২৪.২০২৩ at ১৩:০৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর