দৌলতপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্থবিরতা

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন। যা পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি রংচঙ লাগিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে দেশজুড়ে শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তবে ভিন্ন পরিস্থিতি কুষ্টিয়ার ভারতীয় সীমান্তবর্তী পৌনে ৫শ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ৮ লাখের বেশি মানুষের উপজেলা দৌলতপুরে। যদিও উপজেলাটির বেশ কয়েক ব্যক্তি শিল্পকলার নানা বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমাদৃত। এক সময়ের জমজমাট উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি এখন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। ভাটা পড়েছে সাংস্কৃতিক বিকাশে। এখানকার নির্বাহী কমিটি থেকে শুরু করে প্রশিক্ষক আর শিক্ষার্থী-শিল্পী মিলে সদস্য সংখ্যা ঘুরেফিরে কার্যত জনাদশেকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

অনেকগুলো বছর ধরে কয়েকব্যক্তির মনগড়া পরিচালনায় দৌলতপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি এখানকার সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাতেগোনা দুয়েক ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিরা। এই শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।

জানা যায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অন্তর্ভূক্ত সকল জেলা ও উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনার জন্য শিল্পকলা একাডেমি পরিষদ অনুমোদিত, একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী স্বাক্ষরিত গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা রয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই মেনে আসেননি এই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরা।

সম্প্রতি উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সরকার আমিরুল ইসলাম তার ব্যবহৃত ফেসবুক পেজে শিল্পকলার নতুন সদস্য আহ্বান করেন। আভাস দেয়া হয়, পুরনো স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন করে কমিটি করার মধ্য দিয়ে একাডেমির কার্যক্রমকে গতিশীল করা হবে। সেই মোতাবেক এককালীন চাঁদা পরিশোধের মধ্য দিয়ে নতুন সদস্য হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এর কয়েকদিন পরেই নতুন পুরনো সদস্যদের বৈঠক ডাকা হয়। ওই বৈঠকের আলোচনায় হঠাৎই নতুন কমিটির প্রসঙ্গ তুলে আনা হয়। গঠনতন্ত্র বা নিয়মনীতির ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে একটি প্রস্তাবিত কমিটি করা হয়। বলা হয়, এই আংশিক কমিটির সাথে উপজেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি মনোনীত নতুন সদস্যদের অন্তর্ভূক্ত করার পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। কিন্তু ওই বৈঠকে কমিটি উত্থাপন সংক্রান্ত প্রস্তাব গঠনতন্ত্র বিরোধী হওয়ায় তা না করতেও বক্তব্য প্রদান করেন উপস্থিত সদস্যরা। তবে, গঠনতন্ত্র যা ভাঙা হচ্ছে নিজেই ভাঙছেন জানিয়ে বিষয়টি মেনে নিতে আহ্বান জানান সভার সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার।

এদিকে পুরনো কমিটি বিলুপ্ত আর নতুন কমিটি প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির রজতজয়ন্তী উৎসব আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়। সেখানেও ঘটে বিপত্তি। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। এই উৎসবের অপর দুই অতিথি প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, বাউল সাধক শফি মণ্ডল এবং কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য আ. কা. ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ভর্ৎসনা করে বক্তব্য দেন। তারা এই শিল্পকলা একাডেমির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেন।

আরেকদিকে একাডেমির প্রাক্তন কোনো শিক্ষার্থীকে রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানানো হয়নি বলেও ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন একাধিক শিক্ষার্থী। যারা শিল্পকলার বাইরে থেকে এখনো সংগীত চর্চায় নিয়মিত আছেন, জয় করছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিযোগিতাও।

সাধারণ সম্পাদক সরকার আমিরুল ইসলামের একান্ত অনুগত কয়েকজন ছাড়া এই শিল্পকলার সাথে এ উপজেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কারোরই কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে একাডেমির কার্যক্রমও আটকে আছে কেবল পাঁচ-ছয়জনের একটি গানের দলে। বাকি সব কলা রয়েছে বেহালে। চলছে শিল্পকলার নামে নানামুখী ছলাকলা। আর্থিক বরাদ্দেও নয়ছয়ের ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সরকার আমিরুল ইসলাম। যার স্বেচ্ছাচারিতায় সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সংগৃহীত ছবি।

উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির দুয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থী ও শিল্পী নিজেরাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শিল্পকলার বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন উপজেলা পরিষদের ব্যবহার অনুপযোগী বহু পুরনো একটি ভাঙা মিলনায়তনে। সেখানেই দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলছিল এই শিল্পকলার কার্যক্রম। সম্প্রতি আকস্মিক তড়িঘড়িতে একাডেমির কার্যক্রম চালানোর জন্য রংচঙ লাগিয়ে শিল্পকলার নামে বরাদ্দ দেয়া হয় আরেকটি পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবন। ঝুঁকি নিয়ে এই জরাজীর্ণ ভবনেই চালানো হচ্ছে বর্তমান কার্যক্রম।

সদস্য সংগ্রহের শুরুতেও যেমন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিয়ম মানেননি, তেমনি আরেক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি ইউএনও আব্দুল জব্বার সম্পাদিত ‘সংস্কৃতির খেয়া’ নামক একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। রজতজয়ন্তীর ওই আয়োজনেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয় নির্বাহী কমিটির পরিচয়। যা এখানকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেককেই হতবাক করেছে।

অথচ গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, পুরনো কমিটি বিলুপ্তি বা নতুন কমিটির সূচনার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। যদি উপজেলা কালচারাল অফিসার না থাকেন সেক্ষেত্রে সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করবেন জেলা কালচারাল অফিসার ও কমিটি সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

কুষ্টিয়া জেলা কালচারাল অফিসার সুজন রহমান জানান, দৌলতপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির কমিটি সংক্রান্ত কোনো কিছু তাদের জানানো হয়নি। কেবল কেন্দ্র অনুমোদন দিলেই জেলা-উপজেলায় কমিটি হওয়া সম্ভব। জেলার কোনো উপজেলায় কমিটি প্রক্রিয়াধীন থাকলে সেটিও কেন্দ্র থেকে তাদের জানানো হয় বলে তিনি জানিয়েছেন।

নতুন প্রজন্মের পেশাদার এক সংগীতশিল্পী নাম প্রকাশে অনিচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন, শিল্পকলা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। প্রকৃত শিল্পীদের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমি কোনো সম্পৃক্ততা রাখে না। এই একাডেমি নিজের মনের মতো করে চালান সাধারণ সম্পাদক সরকার আমিরুল ইসলাম। এখন দিন বদলেছে, তার এই স্বেচ্ছাচারী বিষয়টি নিয়ে সকল মহলের চিন্তার সময় এসেছে। উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির এই সদস্য আরো বলেন, আমি একজন সদস্য হয়েও জানি না কবে কীসের কমিটি হয়েছে।

যুগের বেশি সময় সংগীত গুরু হিসাবে কাজ করছেন উপজেলা শিল্পকলার এমন এক সদস্য মনগড়া নতুন কমিটি সম্পর্কে জানান, শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের মিটিংয়ের কথার সাথে বাস্তবতার মিল নেই। তারা সবকিছু একা একা করে আসছেন। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসবের প্রতিকার হওয়া জরুরি। এই শিল্পকলা একাডেমি নিতান্তই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং তাদের কয়েকজন অনুসারীর মন মতো চলে। এখানে শিল্পকলার যুগোপযোগী কোনো চর্চা হয় না। নতুন শিক্ষার্থী তৈরি বা শিল্পী তৈরির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচেষ্টাই নেই।

উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী সরকার আমিরুল ইসলাম বলেন, নতুন কমিটি প্রক্রিয়াধীন, আমরা নিজেরা যেটা করেছি সেটাই চূড়ান্ত কমিটি। জেলা থেকে আমাদের জানিয়েছে, কেন্দ্র থেকে অনুমোদন না দিলেও এভাবে চালিয়ে যেতে বাধা নেই। তাই আমরা জেলার মতামতের ভিত্তিতে সকল কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।

দৌলতপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল জব্বার জানান, এখান থেকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে কমিটি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো রেসপন্স আসেনি। তাহলে কীভাবে নির্বাহী কমিটি প্রকাশ হলো, জানতে চাইলে এর সদুত্তর দিতে পারেননি ইউএনও।

জানুয়ারি ২২.২০২৩ at ১২:০৬:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর