সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আগমনে কানায় কানায় পূর্ণ ইজতেমা ময়দান

আমরা জানি যে ১৯৬৭ সাল থেকে ঢাকা থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশাল ময়দানে তাবলীগের জামাত অনুষ্ঠিত হয় । ধীরে ধীরে তাবলীগের কাজ প্রচলিত হওয়ার ফলে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের জায়গার সংকট হতে থাকে। তাই ২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমাকে দুই পর্ব ভাগ করা হয়। যার প্রথম ভাগ হবেঃ- ১৩,১৪,১৫, জানুয়ারি ও ২য় ভাগ হবেঃ- ২০,২১,২২, জানুয়ারি ২০২৩ইং।

শুক্রবার তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের আম বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা। রোববার ১৫ই জানুয়ারি দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে প্রথম পর্ব শেষ হবে। ৪ দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় র্পর্ব ২০শে জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২২শে জানুয়ারি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে। ইজতেমাকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে ময়দানের সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

বৈশ্বিক মহামারি কারোনার কারণে গত ২ বছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। আজ শুক্রবার আম বয়ানের মধ্যদিয়ে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১০ই জানুয়ারি থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে এসে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। যাতায়েত ব্যাবস্থাঃ ইজতেমা কেন্দ্র করে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানা যায়, ট্রফিক বিভাগকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ঢেলে সাজিয়েছি।

আরো পড়ুন:
> ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার একই দিনে বায়োমেট্রিক
> কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে তথ্য দেন, ব্যবস্থা নেব: প্রধানমন্ত্রী

আব্দুল্লাহপুর থেকে ধীরাশ্রম একটা সেক্টর, আরেকটা মুন্নু গেট থেকে কামারপাড়া ব্রিজ, কামারপাড়া ব্রিজ থেকে ভোগড়া চৌরাস্তা, ভোগড়া চৌরাস্তা থেকে তিনশ ফিট রাস্তা এবং চৌরাস্তা কোনাবাড়ি হয়ে ডাইভারশন রোডকে ভাগ করেছি। যদি আমরা দেখি রাস্তায় জ্যাম চলে আসে তাহলে তিন’শ ফিট হয়ে আমরা ঢাকায় গাড়ি ঢুকাবো ও আশুলিয়া হয়ে কোনাবাড়ি দিয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় গাড়ি ঢুকবে।

আইনশৃঙ্খলা: বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীতে আইনশৃঙ্খলা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তার লক্ষ্যে ইজতেমার ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র্যা ব, সাদা পোশাকধারীসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। তবে গত বুধবার থেকেই ময়দানের প্রতিটি প্রবেশপথে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

নিরাপত্তা জোরদার করতে র্যাববের কমিউনিকেশন উইং ও পুলিশের পক্ষ থেকে ১৮টি প্রবেশপথসহ চারপাশের গুরুত্বপূর্ণস্থানে শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এ ছাড়াও থাকছে মেটাল ডিটেক্টর, নাইটভিশন গগল্স, বাইনোকুলার, বোম্ব ডিসপোজাল টিম, হেলিকপ্টার-নৌ-টহল ও স্টাইকিং ফোর্স। র্যা বের ইন্টেলিজেন্সের সদস্যরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ ইজতেমা মাঠে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি রাখবেন। প্রতিটি খিত্তায় বিশেষ টুপি পরিহিত ও সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা সদস্য অবস্থান করবেন। এ ছাড়াও তারা ইজতেমা মাঠসহ আশপাশের কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে প্রত্যক্ষ করার জন্য ল্যাপটপ কম্পিউটারের স্ক্রিনে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখবেন। ১২টি গাড়িসহ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সতর্কাবস্থায় রাখা হবে।

নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে বসানো র্যাযবের ১০টি ও পুলিশের ১৫টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষক দল সার্বক্ষণিক বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া জিএমপি কমিশনারের দিক নির্দেশনায় টঙ্গী পশ্চিম থানা পুলিশ ইজতেমার আগ থেকেই ময়দান ও আশপাশের এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সার্বক্ষণিক কঠোর ভুমিকা পালন করছে।

চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম: মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে প্রথমপর্বে ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেয়া হয়েছে। গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিস এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, টঙ্গী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালকে ইজতেমার মুসল্লিদের জন্য প্রস্তুত রাখার হয়েছে। সেইসঙ্গে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, বক্ষব্যাধি/অ্যাজমা ইউনিট, হৃদরোগ ইউনিট, ট্রমা (অর্থোপেডিক) ইউনিট, বার্ন ইউনিট, ডায়রিয়া ইউনিট, স্যানিটেশন টিম এবং ১৪টি এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও চক্ষু, মেডিসিন ও সার্জারিসহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসক রোস্টার অনুযায়ী চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকবেন।

পানি ও গ্যাস সরবরাহ: ইজতেমা আয়োজক তাবলীগ জামায়াতের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুতি ছাড়াও ওয়াসা, তিতাসসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থাগুলোও তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। স্থানীয় ওয়াসা ও তিতাস গ্যাস কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, ইজতেমা ময়দানে আগের ১৪টি গভীর নলকূপ ছাড়া ও আরো ২টি নতুন নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।

সাড়ে ১২ কি. মি. পাইপ লাইনের মাধ্যমে যা থেকে দৈনিক প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ৫৪ লাখ গ্যালন সুপেয় পানি মুসল্লিদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর মিয়া। এবারও নতুন করে ৫শ’ অস্থায়ী টয়লেট ছাড়াও প্রায় ৯ হাজার স্থায়ী টয়লেট, গোসল ও অজুখানা তৈরি ও মেরামত করা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়াসা কর্তৃপক্ষও তাদের গাড়ির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পানি সরবরাহ করবে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ইজতেমা ময়দানের বিদেশি মেহমানখানায় রান্নাবান্নার প্রয়োজনীয় স্থানে ১৭০টি গ্যাসের চুলা স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়াও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মুসল্লিদের যাতায়াতের রাস্তায় ধুলাবালি প্রতিরোধে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি ছিটানো হবে।

বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা: ইজতেমা মাঠের উত্তরপাশে ইবনে সিনা, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, র্যা ব, সহ ২৭টি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে তাদের তৈরীকৃত স্টলে আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহ করবে।

মুসল্লির মৃত্যু: ইজতেমায় ৭ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বাদ জোহর ইজতেমা ময়দানে তাদের ২জনের জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিহতরা হলেন- গাজীপুর শহরের ভুরুলিয়া এলাকার বাসিন্দা আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব (৯০) এবং সিলেটের জৈন্তাপুর থানার হরিপুরের হেমুবটেপাড়া এলাকার মো. ফজলুল হকের ছেলে মো. নুরুল হক (৬৩)। বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুন নূর ও টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাষ্টার জেনারেল হাঁসপাতাল সুত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদের মধ্যে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে তাবলীগ জামায়াতের গাজীপুর মারকাজের শুরা সদস্য তৈয়ব সকাল ১০টার দিকে মারা গেছেন। আর নুরুল হক ভুগছিলেন অ্যাজমা রোগে। সকালে ইজতেমা ময়দানের ৬২ নম্বর খিত্তায় অবস্থানকালে নুরুল হকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি মারা যান। দুপুরে ইজতেমা ময়দানে জানাযা নামাজ শেষে লাশ দু’টি তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এপর্যন্ত সাড়ে পাচ হাজারের অধিক মুসল্লি কে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরুর আগের দিনই পুরো ময়দানের জেলা ভিত্তিক সকল খিত্তা মুসল্লিতে পূর্ণ হয়। মাঠের মূল অংশে মুসল্লিরা ঠাঁই না পেয়ে কামারপাড়া ও আশপাশের এলাকায় ফুটপাথে অবস্থান নিয়েছে।

ইজতেমা কমিটির বক্তব্য: বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি মেজবাহ উদ্দিন জানান, ইজতেমা ময়দানের প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন রয়েছে। প্রথমপর্বে অংশগ্রহণকারী ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ময়দানে স্ব-স্ব খিত্তায় এসে অবস্থান নিচ্ছেন। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা থেকে লাখ লাখ মুসল্লি প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবে, ইনশাআল্লাহ।

  ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের কথাঃ ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা জানায়, এবারে ইজতেমা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সুন্দর ভুমিকা পালন করেছে। রাস্তা ঘাটে তেমন যানযট চোখে পরেনি। জেলা ভিত্তিক প্রতিটি খিত্তা সুন্দর ভাবে ঘোছানো ছিলো তেমন কষ্ট হয়নি। খাবার, গ্যাস, টয়লেট ও পানির জন্য তেমন কোন কষ্ট হচ্ছেনা। আশপাশে প্রয়োজনীয় সকল কিছুই খুব সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। এবারের ইজতেমা ময়দানে যেসকল মুসল্লি ভাইয়েরা এসেছেন তাদের অনেকেই বলেছেন কারোই কোন কিছুতে বিগ্নতা ঘটেনি। আমরা আশা রাখি আখেরি মুনাজাত শেষ করে সুন্দর ভাবেই বাড়ি ফিরতে পারবো।

জানুয়ারি ১৪, ২০২৩ at ১৬:৩৯:০০(GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ/ইমস