দৌলতপুরে মেলায় লটারির নামে জুয়া, প্রশাসন নীরব

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই আয়োজিত অবৈধ মেলায় অনুষ্ঠিত লটারির ড্র। শনিবার রাতের ছবি।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় অবৈধভাবে শুরু হয়েছে মেলা ও লটারির নামে জমজমাট জুয়া। কোনো মেলা, সার্কাস এমনকি ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের জন্য প্রশাসনের অনুমতি নেয়ার নিয়ম থাকলেও এখানে তা উপেক্ষিত রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় ব্যক্তির ইচ্ছায় দৌলতপুর থানার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই অবৈধ মেলা ও লটারির নামে জুয়া চলছে। এতে পুরস্কার পাওয়ার আশায় প্রতিদিন রাতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিপুলসংখ্যক মানুষ মেলার মাঠে ভিড় করছে। এই অবৈধ মেলা ও লটারির ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন জেনেশুনেও সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকায় রয়েছে।

জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় স্থানীয় নেতার পরিচালনায় গত চারদিন আগে (৪ জানুয়ারি) দৌলতপুর উপজেলার শিতলাইপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে শুরু হয় অবৈধ মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করে সেখানে কার্যত চলছে লটারির নামে জুয়ার আসর। এতে মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, সোনার গয়নাসহ বিভিন্ন পুরস্কার পাওয়ার প্রলোভনে পড়ে মেলামুখী হচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোর ও দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নানা বয়সী হাজারো মানুষ।

মেলায় লটারির ছদ্মাবরণে এই জুয়ার টিকেট বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা করে। আর ‘আকর্ষণীয়’ পুরস্কার পেতে একেকজন ১০ থেকে ২০-৩০টি পর্যন্ত টিকেট কিনছে। এই টিকেটের টাকা জোগাড় করতে অনেকে বিপথগামী হচ্ছে। তারা অনৈতিক পথ অবলম্বন করছে। কনকনে শীতের মধ্যে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে কথিত মেলা ও লটারি নামক জুয়া। ‘বিজয় মেলা’ নাম দিয়ে আয়োজিত এই মেলায় আরো লোক সমাগম ঘটাতে সার্কাস আয়োজনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এই মেলার মাধ্যমে আয়োজক কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় মাইকিং করে মেলায় চলা লটারির নামে এই জুয়ার টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। ব্যাটারিচালিত অটো, পাখিভ্যানসহ অন্যান্য পরিবহনে করে এসব টিকেট বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বাড়ি বসে নারীরাও সোৎসাহে কিনছেন এই টিকেট। প্রতিটি টিকেটের দাম নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। যা র‍্যাফেল ড্র হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে, বিভিন্ন ‘আকর্ষণীয়’ পুরস্কারের ঘোষণা। বিভিন্ন বাজারে অবস্থান নিয়ে এসব টিকেট বিক্রি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া মেলা মাঠের নির্দিষ্ট স্থানেও বিক্রি হচ্ছে টিকেট। কথিত র‍্যাফেল ড্রয়ের এই টিকেট কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন মানুষজন।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আয়োজিত অবৈধ মেলার প্রধান আকর্ষণ লটারির টিকেট বিক্রির গাড়ি।

 

দিন শেষে বিভিন্ন এলাকা থেকে একে একে মেলাস্থলে আসে টিকেট বিক্রির গাড়ি। রাত ১০টায় ড্রাম থেকে ঢালার সময় হাজার হাজার টিকেটের স্তুপ পড়ে যায়। গভীর রাতে শুরু হয় লটারি। স্থানীয় ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এতে প্রথম পুরস্কার নিম্নমানের মোটরসাইকেল দেয়া হয়। মূলত মোটরসাইকেল পেতেই টিকেট বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এভাবেই লটারির নামে জুয়ার আসরে ধুন্ধুমার অবৈধ বাণিজ্য চালানো হচ্ছে।

দৌলতপুর থানার পার্শ্ববর্তী এলাকা শিতলাইপাড়ায় অনুষ্ঠিত এই অবৈধ মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্টল। যেখানে রয়েছে হরেক রকম পণ্যের পসরা। তবে মেলায় আগতদের মূল আকর্ষণ লটারি নামক জুয়া। এই জুয়ার টিকেটের টাকা জোগাড় করতে শিশু-কিশোররা অনৈতিক পথে ধাবিত হচ্ছে। আর দিনমজুর শ্রেণির লোকজন দিন শেষে মেলার মাঠে লটারিমুখী হচ্ছেন। তারা সারাদিনের আয়ের বড় একটি অংশ জুয়ায় খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরছেন। ঘটছে পারিবারিক কলহ। কার্যত জুয়ার কারণেই মেলায় জড়ো হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষ। প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এতে আয়োজক কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছেন কয়েক লাখ টাকা।

জেলা প্রশাসনের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের ব্যানারে মেলাটি আয়োজন করা হয়েছে। মেলা কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, মেলা আয়োজনে ২১ দিনের অনুমতি নেয়া হয়েছে। এখনো দুই সপ্তাহের বেশি এই মেলা চলবে। নতুন আকর্ষণ হিসাবে আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে মেলায় যুক্ত হচ্ছে সার্কাস ও যাত্রাপালা। এদিকে মেলাকে কেন্দ্র করে সচেতন এলাকাবাসীর মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা মেলায় লটারির নামে চলে আসা জুয়া বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনুষ্ঠিত অবৈধ ‘বিজয় মেলা’র প্রবেশ পথ।

কথিত ‘বিজয় মেলা’ আয়োজক কমিটির সভাপতি স্থানীয় যুবলীগ নেতা বখতিয়ার রহমান বাচ্চুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

আয়োজক কমিটির একটি সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। সুশৃঙ্খলভাবে মেলা চলছে। বিজয়ের মাসে এই মেলাটি আরম্ভ করার কথা ছিল। কিন্তু তখন করা সম্ভব হয়নি। মেলায় অবৈধ কিছু নেই। প্রচুর লোকসমাগম হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, সুন্দরভাবে মেলাটি সম্পন্ন হবে।

দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, মেলায় অবৈধ লটারি বন্ধের ব্যাপারে আমরা অচিরেই ব্যবস্থা নেব। বিষয়টি নিয়ে ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি সময় দিলেই মেলাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল জব্বার জানান, মেলা আয়োজনের ব্যাপারে প্রশাসনের তরফে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। কারো গায়ের জোরে মেলার নামে অবৈধ কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, রাত ১২টা পর্যন্ত কোনো মেলা চলে তা আমার জানা ছিল না, এ আবার কীসের মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে দায়ভার কে নেবে। আয়োজক কর্তৃপক্ষ যত ক্ষমতাধরই হোক ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না।

জানুয়ারি ০৮.২০২৩ at ১৫:৩১:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এমএইচ