আলবিসেলেস্তেদের পক্ষে জোড়া গোল করেন লিওনেল মেসি। অপর গোলটি করেন ডি মারিয়া। ফ্রান্সের পক্ষে হ্যাটট্রিক করেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের ফাইনালে শুরুতেই চমক আর্জেন্টিনার। টুর্নামেন্টজুড়ে দাপুটে ফুটবল খেলা ফ্রান্সকে ৩৮ মিনিটের মাথায়ই ২ গোল দিয়ে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা কাটানোর স্বপ্ন দেখতে থাকে আর্জেন্টিনা। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ফাইনাল খেলা মেসিকে কাঁদতে হয়েছিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়। সেবার জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা।
আলবিসেলেস্তেদের বিপক্ষে হারার ফলে ব্যাক টু ব্যাক বিশ্বকাপ জেতা হলো না ফ্রান্সের। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকা ফ্রান্স দ্বিতীয়ার্ধের ৮০ এবং ৮১ মিনিটে এমবাপ্পে এক মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল পরিশোধ করে ম্যাচে ২-২ গোলে সমতা ফেরান। ৭৮ মিনিটে কুলো মুয়ানিকে ডিবক্সের ভেতর ফাউল করে বসেন ওতামেন্দি। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির বাঁশি বাজান। স্পট কিক থেকে বিশ্বকাপে নিজের ৬ষ্ঠ গোলটি করেন এমবাপ্পে। এই গোলের রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও গোল করেন এমবাপ্পে। ৮১ মিনিটে দুর্দান্ত ভঙ্গিতে গোল করে দলকে ২-২ এ সমতায় ফেরান এই পিএসজি তারকা।
গতকাল প্রধমার্থের শুরু থেকে ফ্রান্সকে চেপে ধরে আর্জেন্টিনা। ২১তম মিনিটে বাঁ দিক থেকে আলভারেসের পাওয়া বল বক্স থেকে বাইলাইন দিয়ে শট নিতে যাওয়ার মুহূর্তে ওসমান দেম্বেলের ফাউলের শিকার হন দি মারিয়া। তাতেই পেনাল্টির বাঁশি রেফারি সিমন মার্চিনিয়াক । ফাউলটি এতই স্পষ্ট ছিল যে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তিও (ভিএআর) ঘটনাটি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। স্পটকিক থেকে ফ্রান্সের গোলকিপার হুগো লরিসকে ফাঁকি দিয়ে ডান দিক দিয়ে নেয়া শটে গোল করেন মেসি।
এই গোলের মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপে অনন্য একটি রেকর্ডও গড়েন মেসি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে গোল করা ও করানো মিলিয়ে মোট ২০টি গোলে প্রত্যক্ষ অবদান রাখলেন মেসি। বিশ্বকাপে মেসি নিজে করেন ১২ গোল, আর বানিয়েছেন আরও ৮ গোল। বিশ্বকাপে গোল করা ও গোল বানানো মিলিয়ে এর আগে জার্মানির সাবেক স্ট্রাইকার মিরোস্লাভ ক্লোসা ও ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনালদোর সঙ্গে যৌথ অবস্থানে ছিলেন মেসি। গোল করা ও বানানো মিলিয়ে ১৯ গোলে অবদান ছিল তিনজনের।
প্রথমার্ধের ৩৬ মিনিটে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি ছিল চোখ ধাঁধানো। ফরাসি রক্ষণ ফাঁকা পেয়ে ডান প্রান্তে জুলিয়ান আলভারেজকে পাস বাড়ান মেসি। আলভারেজ বাঁ প্রান্তে বল বাড়ান আরও ভালো অবস্থানে থাকা ডি মারিয়াকে। ফ্রান্সের গোলকিপার হুগো লরিস দি মারিয়াকে আটকাতে এগিয়ে গেলেও ঠান্ডা মাথার ফিনিশিংয়ে বল জালে চালান করেন ডি মারিয়া।
গোল করার কিছুক্ষণ পর দি মারিয়াকে কাঁদতে দেখা যায়। খেলছিলেন আর চোখ মুখছিলেন। হয়তো ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি মনে পড়েছিল তার। ঊরুর চোটে পড়ে আর্জেন্টিনার সেই ফাইনাল খেলতে পারেননি। সেবার হারলেও এবার বিশ্বকাপে হারেনি আর্জেন্টিনা।
গতকাল বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে নামার আগে ৭টি রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মেসি। ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনাল খেলতে নেমেই গড়েন বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড। শুধু তাই নয়, গোল করে গড়েন আরও কয়েকটি রেকর্ড।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ২৫টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড ছিল জার্মানির লোথার ম্যাথাউসের। সেমিফাইনালেই ম্যাথাউসকে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন মেসি। এবার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে নামার পরই মেসির নামের পাশে যোগ হলো ২৬ ম্যাচ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড এখন মেসির দখলে। শুধু সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় (মিনিট) খেলার রেকর্ড এখন মেসির দখলে। ইতালিয়ান কিংবদন্তি পাওলো মালদিনি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২২১৭ মিনিট খেলেছিলেন। ফ্রান্সের বিপক্ষে ২৪ মিনিট খেলার পরেই মালদিনির রেকর্ড পার হয়ে যান আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। ফাইনাল খেলতে নামার সময় মেসির নামের পাশে শোভা পাচ্ছিলো ২১৯৪ মিনিট।
ফ্রান্সের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করেই পেলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেন মেসি। বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির গোল মোট ১২টি। পেনাল্টি থেকে গোল করার পর মেসিরও গোল সংখ্যা ১২।
গতকাল কাতারে বিশ্বকাপ জেতার মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করেন লিওনেল মেসি। প্রাচুর্যময় ক্যারিয়ারে এত দিন মেসির একমাত্র অপূর্ণতা ছিল বিশ্বকাপের ট্রফি। ফ্রান্সকে হারানোর মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। পঁয়ত্রিশে পা রাখার আগেই ক্লাব ফুটবল, জাতীয় দলে মিলিয়ে চুুমু এঁকেছেন ছিলেন ৪১টি ট্রফিতে। এর মধ্যে আছে বার্সেলোনা ও পিএসজি মিলিয়ে ১১টি লিগ শিরোপা। আছে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের তৃপ্তিও। সাতবার হয়েছেন বর্ষসেরা ফুটবলার। কিন্তু অপূর্ণতা সেই সোনালি ট্রফিটি। আর সেটি শোকেসে তোলার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ফুটবলে পেলে-ম্যারাডোনার কাতারে মেসি। অনেকে আর্জেন্টাইন জাদুকরকে কিংবদন্তি ম্যারাডোনার চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন। বিশ্বকাপ জিতলেও কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে পারেননি ম্যারাডোনা। মেসির বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ এবং কোপা আমেরিকার শিরোপা