ধ্বংসের মুখে ২ জমিদার বাড়ি, সংরক্ষণ হলে বাড়বে দর্শনার্থী

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার দুটি জমিদার বাড়ি। এর মধ্যে একটির অবস্থান সদর ইউনিয়নের গোপালদী সদাসদী এলাকায় আরেকটির ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের বালিয়াপাড়া এলাকায়। দুটি বাড়িরই আছে ঐতিহ্য এবং বিশেষত্ব। যে কাউকেই মুগ্ধ করতে পারে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে বাড়ির দুটি এখন ধ্বংসের পথে।

ছবি: সংগৃহীত

যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে তা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিণত হবে বলে আশাবাদী স্থানীয়রা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বর্তমান গোপালদী পৌরসভা এলাকায় তিনটি জমিদার পরিবার ছিল। তারা হলো- সরদার পরিবার, তেলি পরিবার এবং ভূঁঞা পরিবার। এদের মধ্যে সম্পদ এবং ক্ষমতার মাপকাঠিতে এগিয়ে ছিল সরদার পরিবার। সরদার পরিবারের তিন সন্তান প্রসন্ন কুমার, মরিন্দ্র কুমার আর গোপাল চন্দ্র। সেই গোপালচন্দ্রের নামানুসারেই বর্তমান গোপালদী নামটি রাখা হয়। এ জমিদার বংশের শেষ জমিদার ছিলেন গোপাল চন্দ্রের ছেলে খোকন সর্দার। যিনি স্বাধীনতার পরে ভারতে চলে যান। এখানে তিনটি জমিদার বাড়ির আরেকটি হলো ভূঁঞা জমিদার বাড়ি।

ভূঁঞা জমিদাররা ছিলেন দুই ভাই। হরিচন্দ্র ভূঁঞা ও কানাইচন্দ্র ভূঁঞা। এ জমিদার বংশের শেষ জমিদার ছিলেন জগবন্ধু জমিদার। বাড়িটির অবস্থান আড়াইহাজার উপজেলা থেকে সাত-আট কিলোমিটার পূর্বে। প্রায় ৬০ শতাংশ জমির ওপর ১৩২৩ বঙ্গাব্দে গড়ে তোলা হয় ভবনটি। এটি সদাসদী জমিদার বাড়ি নামেও পরিচিত। বাড়িটির বিশেষত্ব ছিল ১০১টি কক্ষবিশিষ্ট। দুতলা ভবনের এ জমিদার বাড়ির কারুকাজ দেখে যে কেউই অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবেন। ভবনের নিচতলায় চলতো দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড আর দ্বিতীয় তলায় ছিল শয়ন কক্ষ, জলসাঘর ও পূজা-অর্চনার ঘর। বাড়ির সম্মুখপানে প্রসস্থ একটি উঠোন যার তিনদিকে আছে আরও তিনটি বাড়ি।

এসব বাড়ির নির্মাণশৈলীতে মোগল আমলের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে একটি বিশাল পুকুরের। পুকুরে দুটি শানবাঁধানো ঘাট। অনেক আগে এ দুই ঘাটের মধ্যে একটি দেওয়াল ছিল, যা দিয়ে দুটি ঘাটে একটা পর্দা তৈরি করা হয়েছিল। ঘাটগুলোর একটিতে পুরুষ, অন্যটিতে মেয়েরা গোসল করতেন। এদিকে সংস্কারের অভাবে ক্ষয়ে পড়েছে দোতলা ভবনের ৫০টি কক্ষ। অযত্ন আর অবহেলায় ভেঙে পড়েছে রন্ধনশালা। লতাগুল্ম গজিয়ে ঢেকে গেছে পূজা-অর্চনার ঘর ও শৌচাগার। কারুকার্য খচিত দরজা-জানালাগুলো এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। খসে পড়েছে মূল স্থাপনার পলেস্তারাসহ নানা অংশ।

ছবি: সংগৃহীত

চুরি হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান পাথরসহ আসবাবপত্র। বর্তমানে বিশাল এ জমিদার বাড়িতে বিভিন্ন লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। বাড়ির আশপাশ এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও সেখানে বসবাস করছেন।সেখানকার এক বাসিন্দা অঙ্কীতা রানী দাস বলেন, আমরা এখানে অনেক দিন ধরেই বসবাস করছি। প্রতি মাস শেষে ভাড়া দিয়ে থাকি।

অন্য বাসার তুলনায় এখানে ভাড়া কম তাই ভাড়া নিয়ে থাকছি। তপন চক্রবর্তী বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই এ বাড়িতে বসবাস করছি। প্রতি মাস শেষেই ভাড়া দিয়ে থাকি। বর্তমানে সবমিলিয়ে প্রায় ৫০টি পরিবার এখানে বাস করে। শতবর্ষী যতীন্দ্র চন্দ্র সাহা বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই এখানে বসবাস করছি। স্বাধীনতার আগেই বাড়িটি খালি হয়ে যায়। আগে এখানে একটি স্কুল ছিল। এখন কিছুই নেই। আগে ১০১টি রুম ছিল। এখন ৫০টি রুম আছে। বাকিগুলো সব ভেঙে গেছে। কেউ কেউ ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। বাড়ির সৌন্দর্যও নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক মূল্যবান এখন আর জিনিস নাই।

এদিকে আড়াইহাজারে ঐতিহ্যবাহী আরেকটি জমিদার বাড়ি হলো স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নির্দেশনা বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ি। স্থানীয়ভাবে বলা হয় বাইল্যাপাড়া জমিদার বাড়ি। আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের বালিয়াপাড়া এলাকায় এই বাড়িটির অবস্থান। ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে লাল ইট ও চুন সুরকির মিশ্রণে তৈরি বাড়িটি এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তিনতলা বিশিষ্ট এল ধরনের বাড়ি। বাড়িটির ইতিহাস একশ বছরের পুরনো। বাড়ির মালিক জমিদার মুকুন্দ মুরালির কোনো বংশধর এখানে থাকেন না।

ছবি: সংগৃহীত

দেশ ভাগের পরপরই তারা ভারতে চলে যান। যাওয়ার আগে তাদের সমস্ত জমাজমি বিক্রি করে দিয়ে যান। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাড়িটি রেখে দেন। স্থানীয়রা জানান, জমিদার মুকুন্দ মুরালি তার এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে। এ কারণে তিনি বালিয়াপাড়া বাড়িটি বিক্রি করেননি। দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত জমিদার মকুন্দ মুরালি এ বাড়িতেই বসবাস করতেন।

স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে, বালিয়াপাড়া রাজবাড়ির মালিক মুকুন্দ মুরালি প্রথম জীবনে হিন্দু জমিদার কিশোরী পোদ্দারের খাজাঞ্চি ছিলেন। অনেক পরে মুকুন্দ মুরালি জমিদারি লাভ করেন। জমিদার হলেও মূলত তারা ছিলেন বণিক শ্রেণীর। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসা করতেন। প্রজাবৎসল হিসেবেও তাদের বেশ সুনাম ছিল। অন্য অঞ্চলের জমিদারদের মত কোনো অত্যাচার নিপীড়নের ইতিহাস তাদের নেই।

ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য দেশ ভাগের খুব বেশি আগে তারা জমিদারি পাননি। ফলে তাদের জমিদারি ইতিহাস দেশ ভাগের পরই সমাপ্তি ঘটে কয়েকবছর তারা মাঝে মধ্যে এদেশে আসতেন। তখন তারা এ বাড়িটিকেই থাকতেন। তিন তলা বাড়িটি তখনো ছিল বেশ জমজমাট। ১৯৬৫ সালের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বালিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের টিনসেড ঘর ভেঙে যায়। এতে বিদ্যালয় বন্ধের উপক্রম হয়। তখন এলাকাবাসী জমিদার মুকুন্দ মুরালি কাছে যান। সবাই জমিদারকে স্কুলটি চালু করতে অনুরোধ জানান।

এলাকাবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমিদার বাড়িটিতেই স্কুল চালু করার কথা জানান। ১৯৬৬ সালে জমিদার মুকুন্দ মুরালি ৫ হাজার টাকা দলিল মূলে বালিয়াপাড়া হাইস্কুল পরিচালনা কমিটির কাছে জমিদার বাড়িটি লিজ দেন। বালিয়াপাড়া হাই স্কুল তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত তোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী। তিনি ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। তবে এখন আর সেই বিদ্যালয়ের হদিস নেই।

ছবি: সংগৃহীত

সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়িটি ধ্বংসের পথে। কক্ষগুলো বিলীন হয়ে গেছে। অযত্ন আর অবহেলায় ভেঙে পড়ে যাচ্ছে দেওয়ালগুলো। লতাগুল্ম গজিয়ে ঢেকে গেছে পুরো বাড়ি। কারুকার্য খচিত দরজা-জানালাগুলোর কিছুই অবশিষ্ট নেই। খসে পড়েছে মূল স্থাপনার পলেস্তারাসহ নানা অংশ। চুরি হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান পাথরসহ আসবাবপত্র। স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নির্দেশনাই মুছে যাওয়ার পথে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় সময়ে বখাটেদের আড্ডা জমে থাকে বাড়িটির ছাদে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাদক সেবনের জিনিসপত্র।

ডিসেম্বর ০১, ২০২২ at ১৪:০৭:০০(GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ/ইমস