১৭২ দেশে শ্রমবাজারে যে কারণে কমছে রেমিট্যান্স

বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের কর্মী সংখ্যার অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে না। বর্তমানে বিশ্বের ১৭২টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার রয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনার দাপট এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশেও। দেশের অর্থনৈতিক গতির অন্যতম উৎস্য প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতি কমে গেছে।

এর পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা আসায় রেমিট্যান্সে এর প্রভাব পড়ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বিনিয়োগ পলিসির মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি ব্যাংক রেট এবং খোলাবাজারে ডলারের দাম সমন্বয়ের উপরও জোর দিয়েছেন তারা। অবস্থা বিবেচনায় সরকার বৈধ উপায়ে টাকা আনাসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গুরুত্ব বাড়িয়েছে। খুঁজছে নতুন নতুন শ্রমবাজার। আর পুরানো যেসব দেশে কর্মী যাওয়া কমেছে তার কারণ চিহ্নিত করে নতুন কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে রেমিট্যান্সে। এ মাসে রেমিট্যান্স কমে যায় এক ধাক্কায় ৫০ কোটি ডলার। আগের মাসে আসা ২০৩ কোটি ডলারের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে ১৫৩ কোটি ডলার। এর পরের পুরো অক্টোবর মাসে প্রবাসীরা আরো কম রেমিট্যান্স পাঠান। ওই মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৫২ কোটি ডলার। নভেম্বর মাসের প্রথম চার দিন অর্থাৎ ১ থেকে ৪ নভেম্বর প্রবাসী আয় আসে ২১ কোটি ২৬ লাখ ডলার। এরপর ৫ থেকে ১১ নভেম্বর আসে আরো ৪৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। প্রথম ১১ দিনে মোট রেমিট্যান্স আসে মাত্র ৬৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। যা আগের মাসের একই সময়ের তুলনায় ১১ কোটি ডলার কম। অক্টোবরের প্রথম ১০ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭৫ কোটি ডলার। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করেন, এ ধারা চলতে থাকলে নভেম্বরে রেমিট্যান্স নামবে ১৪০ কোটি ডলারে।

আরো পড়ুন:
ফুলবাড়ীতে বিজিবি এ্যাথলেটিক্স প্রতিযেগিতায় চ্যাস্পিয়ান কক্সবাজার 
ঝালকাঠি টিটিসির অধ্যক্ষের সরকারি গাড়ি, ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডে
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু’র জন্মদিন উপলক্ষে, যবিপ্রবিতে সেমিনার অনুষ্ঠিত 

এদিকে, সিন্ডিকেট জটিলতায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের জট খুলছে না। সৌদী আরব থেকে রেমিট্যান্স আসছে। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নানা কায়দায় টাকা আসার প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্স। অবস্থা বিবেচনায় সরকার মোবাইল ব্যাংকিংয়ে জোর দিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের বাংলাদেশিদের নতুন শ্রমবাজার রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মলডোবা সাড়া জাগিয়েছে। ওখানকার ইমারত নির্মাণ, জাহাজ শিল্প, কৃষিকাজ, কলকারখানা, গার্মেন্টস, বেবি সিটিং ও রেস্তোরাঁয় শ্রমিক হিসেবে গত দুই বছরে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে গেছে।

বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন করে যুক্ত হয়েছে আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার। দেশটিতে একটি নির্মাণ প্রকল্পে এক হাজার ৩৬ জন শ্রমিক পাঠাতে এশিয়া কনটিনেন্টাল গ্রুপ (বিডি) নামে এক রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনুমতি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে জনশক্তি পাঠানোর দ্বার উন্মোচন হয়েছে।

জাপানের সরকারি থিংক ট্যাংক গ্রুপের অতি সা¤প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে সরকার ঘোষিত অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশটিতে প্রায় ৬৭ লাখ ৪০ হাজারের অভিবাসী কর্মীর প্রয়োজন হবে। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। জাপানের এই বিপুল জনশক্তির বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাপানে প্রায় ১৭ লাখ ২০ হাজার প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। জাপান সরকার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও কর্মী নিতে আগ্রহী।

সরকারি তথ্যমতে, বিশ্বের ১৭২টি দেশে কাজ নিয়ে যায় বাংলাদেশিরা। প্রতিবছর বাংলাদেশে থেকে সরকারিভাবে আট থেকে ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে যান। এদের বেশিরভাগই যান অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে। তবে অন্যান্য ভিসা মিলিয়ে ২০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান বলে দাবি করেছে বায়রা। ব্রুনাই, কুয়েত, মরিশাস, সিঙ্গাপুর থেকে রেমিট্যান্স এলেও গতি কমেছে।

আরো পড়ুন:
ফুলবাড়ীতে বিজিবি এ্যাথলেটিক্স প্রতিযেগিতায় চ্যাস্পিয়ান কক্সবাজার 
ঝালকাঠি টিটিসির অধ্যক্ষের সরকারি গাড়ি, ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডে
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু’র জন্মদিন উপলক্ষে, যবিপ্রবিতে সেমিনার অনুষ্ঠিত 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এরপরেই রয়েছে ওমান, কাতার, বাহরাইনের মতো দেশগুলো। জর্ডান, সিঙ্গাপুর, রোমানিয়াতেও অল্প কিছু করে কর্মী যাচ্ছে। কম বেশি মিলিয়ে বৈধভাবে ১৭২টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা যাচ্ছেন। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। এখনো এসব দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন। কিন্তু এসব দেশে বৈধভাবে এখন কর্মীরা যেতে পারছেন না। বৈধভাবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বলিভিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক যাচ্ছে। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। তাদের অনেকে ছুটিতে আসেন। পরে অনেকে ফিরে গেছেন। নতুন দেশগুলোয় যাওয়া কর্মীরা মূলত ক্যাটারিং, নার্স, কেয়ারগিভার ইত্যাদি ভিসায় যাচ্ছেন। তবে ওমান, সৌদি আরবের মতো দেশে বেশিরভাগ শ্রমিক যাচ্ছেন অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে।

জানা গেছে, মহামারির আগে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৯৭ জন কর্মী গিয়েছেন। যদিও ২০১৯ সালে দেশটিতে গিয়েছেন ৩ লাখ ৯৯ হাজার কর্মী। বাংলাদেশ থেকে এখন বেশি কর্মী যাওয়ার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ওমান। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ওমানে ১৭ হাজার ৩৯৮ জন কর্মী গিয়েছেন। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৭২ হাজার ৬৫৪ জন। মূলত নির্মাণ, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে এই কর্মীরা যান। দেশটির অভিবাসী শ্রমিকদের বড় অংশই বাংলাদেশি। সব মিলিয়ে এখানে প্রায় আট লাখ কর্মী রয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে তাদের মধ্যে অন্তত দেড় লাখ শ্রমিক অবৈধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় ওমানের অর্থনীতিও কিছুটা চাপের মধ্যে পড়েছে। সেই কারণে সংকটে পড়েছেন অভিবাসী কর্মীরা।

২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী যাওয়া দেশ হিসাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। ওই বছর দেশটিতে মোট ৯ হাজার ৪১৮ জন কর্মী গেছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে গিয়েছেন ৪৯ হাজার ৮২৯ জন কর্মী।

বাংলাদেশ থেকে ২০২০ সালে ৩ হাজার ৫০৩ জন কাতার গিয়েছেন। আগের বছর দেশটিতে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ২৯২ জন। সবচেয়ে বেশি যাওয়া কর্মীদের তালিকায় জর্ডান রয়েছে পঞ্চম নম্বরে। মূলত পোশাক, আবাসিক ও নির্মাণ খাতে বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা দেশটিতে যান। ওই বছর মার্চ মাস পর্যন্ত ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জর্ডান গিয়েছেন ৩ হাজার ৬৮ কর্মী। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে থেকে যান ২০ হাজার ৩৪৭ জন কর্মী। মরিশাসে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে কর্মীদের যাওয়া শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে দেশটিতে গিয়েছেন ২ হাজার শ্রমিক। এর আগের বছর গিয়েছেন সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক। গার্মেন্ট, পর্যটন, রেস্তোরাঁ আর নির্মাণ খাতে বেশি কর্মী যায়।

এদিকে একসময় বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শ্রমিক কুয়েতে কাজ করতে গেলেও এখন সেখানে কর্মী যাওয়া অনেক কমে গেছে। ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন ১৭৪৩ জন। আগের বছর দেশটিতে গিয়েছেন ১৭ হাজার ৩৯৮ জন। বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, লেবানন, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইটালি, মিসর, ব্রুনাই, জাপান, ইরাক ও যুক্তরাজ্যে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক যায়। মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আগে থেকেই অনেক বাংলাদেশি কাজ করছেন।

আরো পড়ুন:
ফুলবাড়ীতে বিজিবি এ্যাথলেটিক্স প্রতিযেগিতায় চ্যাস্পিয়ান কক্সবাজার 
ঝালকাঠি টিটিসির অধ্যক্ষের সরকারি গাড়ি, ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডে
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু’র জন্মদিন উপলক্ষে, যবিপ্রবিতে সেমিনার অনুষ্ঠিত 

বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মী যাওয়া কমলেও বর্তমানে যে সংখ্যক বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে না। এর কারণ হিসেবে তারা ডলারের দামে বৈষম্য এবং হুন্ডিকে দায়ী করেছেন। এ প্রসঙ্গে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহিদুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, ডলারে খোলাবাজার এবং ব্যাংক রেটের মধ্যে পার্থক্য ঘুচিয়ে সমন্বয় করতে হবে। এছাড়া রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ইনভেস্টমেন্ট পলিসির মধ্যে রাখতে হবে। হুন্ডিচক্রের অপতৎপরতা রোধ করতে হবে।

তিনি বলেন, বিদেশে যেসব কর্মী যাচ্ছেন তাদের ব্যাংক একাউন্ট খোলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রেমিট্যান্স আসছে কোনো ধরনের খরচ ছাড়াই। এর মধ্যে জাপান, কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া বেড়েছে। সব কিছু ঠিকভাবে চললে যুদ্ধ এবং করোনার প্রভাব ছাপিয়ে রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র, ইক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আবুল কালাম আজাদ বলেন, রেমিট্যান্স একটা ফ্লো। ঈদ-বড়দিনসহ উৎসবের সময় এটা বাড়ে। করোনা এবং যুদ্ধের প্রভাবে এখন কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স বাড়াতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে আগামি দুয়েক মাসের মধ্যে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র- ভোরের কাগজ

ডিসেম্বর ০১.২০২১ at ১১:১৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এসআর